দুই ভাই বেরোল দেশ বেড়াতে। তাদের মধ্যে এক ভাই গরীব, অন্য জনের অবস্থা ভাল। দুজনের একটা করে ঘোড়া ছিল; গরীবের ছিল মাদী ঘোড়া, বড় লোকের ছিল মস্ত তেজী ঘোড়া আর গাড়ি। রাত্রি হলে বিশ্রাম করবার জন্য তারা থামল এক জায়গায়।
রাত্রি বেলা গরীব ভাইয়ের ঘোড়ীর এক বাচ্চা হল। বাচ্চাটা গড়িয়ে চলে গেল বড়লোক ভাইয়ের গাড়ির নিচে। পরদিন সকালে বড়লোক ভাই গরীব ভাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলল, ওঠ ওঠ ভাই, দেখ রাত্রে আমার গাড়ীর কেমন বাচ্চা হয়েছে! অন্য ভাই উঠে এসে দেখে বলল, গাড়ীর কি বাচ্চা হয়? ওটা নিশ্চয় আমার ঘোড়ীর বাচ্চা।
তোমার ঘোড়ীর বাচ্চা হয়ে থাকলে তো বাচ্চাটা তার কাছে শুয়ে থাকত।
এই নিয়ে দুই ভাইয়ের ভিতরে লাগল ঝগড়া। তারা গেল আদালতে বিচার চাইতে। বড়লোক ভাই বিচারককে অনেক টাকা ঘুষ দিল।
গরীব ভাই টাকা কোথায় পাবে? সে কেবল সত্যি কথাটা বলল।
শেষটায় ব্যাপারটা গিয়ে পৌঁছুল রাজার কাছে। রাজা দুই ভাইকে ঠেকে পাঠিয়ে বললেন, আগে তোমাদের চারটা হেঁয়ালি বলব। তোমরা হেঁয়ালি চারটের উত্তর বের করে আমাকে বলবে।
হেঁয়ালি চারটি হচ্ছে- কোন জিনিস সবচেয়ে বলবান এবং দ্রতগামী?
সবচেয়ে মোটা কি?
কোন জিনিস সবচেয়ে নরম?
আর কোন জিনিস সকলের চেয়ে প্রিয়?
রাজা তাদের তিন দিন সময় দিলেন ভাবতে। তিনি বললেন চতুর্থ দিন এসে আমাকে উত্তর শোনাবে।
বড়লোক ভাই খানিক ভেবে নিয়ে তার গুরুমার কাছে গেল পরামর্শ চাইতে। গুরুমা তাকে আদর করে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি অমন মুখ ভার করে আছ কেন?
রাজামশাই আমাকে চারটা হেঁয়ালি জিজ্ঞাসা করেছেন। মাত্র তিন দিন সময় দিয়েছেন জবাবের জন্য।
কি হেঁয়ালি শুনি?
প্রথম হল- পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বলবান আর দ্রতগামী কি জিনিস?
এ আবার একটা হেঁয়ালি? আমাদের ঘোড়াটার মতো দ্রুতগামী আর কিছু নেই। তার গায়ে চাবুক ঠোকাবার মাত্র সে পাঁই পাঁই করে এমন ছুটবে খরগোশকে ও ধরে ফেলবে।
দ্বিতীয় হল- পৃথিবীতে সবচেয়ে মোটা কে?
আমাদের শূয়োরের বাচ্চাটা তার মোটা, কি বলব। দু'বছর বয়স, এখনি সে এমন মোটা হয়েছে যে, উঠে দাঁড়াতে পারে না।
এবার তৃতীয় হেঁয়ালি- পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নরম কোন জিনিস?
ওঃ! এ আর শক্ত কি? - পালকের বিছানার মত নরম আর কিছু নেই।
শেষ হেঁয়ালি হল এই- পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কি?
আমার নাতি ইভানুশকা ই সবচেয়ে প্রিয় জিনিস সন্দেহ নেই
প্রণাম হই গুরুমা। এবার আমি জানলাম কি বলতে হবে রাজামশাইকে।
সেই গরীব ভাই কি করল? সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তার সাত বছরের মেয়েটি। এই মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ ছিল না।
মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, বাবা তুমি কাঁদছ কেন?
হায়, কাঁদব না তো কি করব? রাজামশাই আমাকে চারটি হেঁয়ালি জিজ্ঞাসা করেছেন। আমি কখনোই তার উত্তর দিতে পারব না।
কা হেঁয়ালি বল না?
হেঁয়ালিগুলি হচ্ছে- সবচেয়ে বলবান আর দ্রতগামী কোন জিনিস?
সবচেয়ে মোটা কে?
সবচেয়ে নরম কি?
সবচেয়ে প্রিয় কোন জিনিস?
বাবা, রাজামশায়ের কাছে তুমি বলবে- সবচেয়ে বলবান আর দ্রতগামী হল বাতাস।
সবচেয়ে মোটা পৃথিবীর মাটি; কেন না, যা কিছু বাঁচে এবং বাড়ে, সকলের খাবার সে যোগায়।
সবচেয়ে নরম মানুষের হাত, কারণ তখনি মানুষ শোয়, সে তার হাতখানা রাখে মাথার নিচে।
আর পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হল ঘুম। মেয়ে উত্তর করল।
তিন দিন পরে রাজার কাছে দুই ভাই গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তাদের কথা শুনে রাজামশাই গরীব ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ উত্তরগুলি তুমি নিজে ভেবে বের করেছো?, না আর কেউ বলে দিয়েছে?
রাজামশাই, আমার একটি সাত বছরের মেয়ে আছে। সে ই উত্তরগুলি বলে দিয়েছে।
তোমার মেয়ের যদি এত বুদ্ধি তবে এই রেশমের সুতোটুকু দিয়ে আমার জন্য একখানা ফুল-কাটা তোয়ালে বুনে দেয়।
গরীব ভাই সুতুটুকু নিয়ে অত্যন্ত বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফিরে এল। এসে সে মেয়েকে বলল, বড়ই বিপদের কথা মা। রাজামশাই বলেছেন এই সুতোটুকু দিয়ে তুমি তাকে একখানা তোয়ালে বুনে দেবে সকালের ভিতর।
মেয়ে বলল, ভাবনা নেই বাবা। তারপর সে ঝাঁটা থেকে ডাণ্ডাটা ভেঙে নিয়ে এসে তার বাবার হাতে দিয়ে বলল, তুমি এই ডাণ্ডাটা নিয়ে রাজামশাইকে দাও। তিনি যেন তাঁর কারিগরদের দিয়ে ডাণ্ডা থেকে তাঁত তৈরি করিয়ে দেন।সেই তাঁতে তোয়ালে বুনবো। গরীব ভাই রাজামশাইকে ডাণ্ডাটা দিয়ে দিল, আর মেয়ে যা বলেছিল সে কথা জানাল।
তখন রাজা তাকে পঞ্চাশটা ডিম দিয়ে বললেন, তুমি এই বিষয়গুলো তোমার মেয়েকে দাওগে। সে যেন এ থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে আমাকে কাল সকালে দেয়।
গরীব ভাই আরো বেজার হয়ে বাড়ি ফিরল। এক বিপদ কাটে তো আরেক বিপদ উপস্থিত হয়। সে ডিম থেকে ছানা ফোঁটা বার হুকুম মেয়েকে বলল।
দুঃখ করো না বাবা মেয়েটি জবাব দিল। সে ডিমগুলি সিদ্ধ করে, বিকালে আর রাত্রে খাবার জন্য রেখে দিল। তারপর তার বাবাকে আবার পাঠাল রাজার কাছে এই পরামর্শ দিয়ে- রাজামশাইকে বল, ছানাগুলোর জন্য একদিনের খাওয়ার মতো জেনারেল দানা দরকার। একদিনের ভিতরেই ক্ষেতে চাষ করে, বীজ পুঁতে, জনার কেটে তা কুটে ফেলতে হবে। নইলে ছানারা মোটে একটি দানাও মুখে দেবে না।
সব কথা শুনে রাজামশাই মনে মনে অবাক হলেন, মুখে বললেন, তোমার মেয়ের কত বুদ্ধি এইবারেই বোঝা যাবে। তাকে বলো, কাল সকালে এখানে আসতে- কাপড় পরেও আসবে না, না পরেও আসবে না; হেঁটে আসবে না বা ঘোড়ায় চড়ে আসবে না; আমাকে কোনও উপহার দেবে না অথচ দেবেন।
গরীব ভাই ভাবল- হায় হায় এমন বিদঘুটে কাজ কি আমার মেয়ে করতে পারবে? সবই গেল!
কিন্তু সাত বছরের মেয়েটি বলল- বাবা , কিছু ভেবো না। তুমি শিকারীদের কাছ থেকে আমার জন্য একটা জীবন্ত জংলি খরগোশ আর একটা জীবন্ত তিতির পাগলী কিনে আন।
লোকটি গিয়ে খরগোশ আর তিতির কিনে আনল।
পরদিন ভোরবেলা মেয়েটি নিজের কাপড় ছেড়ে, একটা মাছ ধরবার জাল নিয়ে বেশ করে গায়ে জড়াল। তারপর তিতির হাতে নিয়ে খরগোশের পিঠে চড়ে রওনা হল রাজবাড়ী। বাড়ীর ফটকের কাছে রাজামশাইয়ের সঙ্গে দেখা। মেয়েটি নমস্কার করে বলল, আপনার জন্য এই উপহার এনেছি। বলে পাখীটাকে বাড়িয়ে দিল রাজার দিকে। যেই না রাজা সেটাকে ধরতে যাবেন অমনি- হুস্ করে পাখীটা উড়ে গেল।
বেশ বেশ। মা আমি বলেছিলাম, ঠিক তাই করেছ তুমি। আচ্ছা তোমরা তো গরীব; কেমন করে তোমাদের খাওয়া পরা চলে?
বাবা শুকনো ডাঙ্গায় মাছ ধরেন, নদীর জলে জাল পারেন না। আমি সেই মাছ বাড়ী নিয়ে আসি কাপড়ের ভিতর গুজে আর তারই সরুয়া রেঁধে খাই। খুব ভাল লাগে। আপনারও ভাল লাগবে খেলে। হ্যা।
বোকা মেয়ে শুকনো মাটিতে আবার কে মাছ পায়? তারা তো জলে থাকে।
আর, চালাক রাজামশাই, কোথায় দেখেছেন গাড়ীর বাচ্চা হতে? ঘোড়ীরই বাচ্চা হয়, গাড়ীর নয়
তখন রাজামশাই ভারী খুশি হয়ে ঘোড়ার বাচ্চা ফিরিয়ে দিলেন গরীব ভাইকে।