Pages

Friday, October 20, 2017

বাংলাদেশের ইতিহাসঃ আলেকজান্ডার থেকে শশাঙ্ক থেকে বঙ্গবন্ধু

প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ বাংলায় পাওয়া গেছে।
ইন্দো-আর্যদের আসার পর অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্য গঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকে। এই রাজ্যগুলি বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছিল। অঙ্গ বঙ্গ এবং মগধ রাজ্যের বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় অথর্ববেদে প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল। মগধ ছিল একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য। মগধের কথা রামায়ণ এবং মহাভারতে পাওয়া যায়। বুদ্ধের সময়ে এটি ছিল ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে একটি। মগধের ক্ষমতা বাড়ে বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এবং তার ছেলে অজাতশত্রুর (রাজত্বকাল ৪৯১-৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) আমলে। বিহার এবং বাংলার অধিকাংশ জায়গাই মগধের ভিতরে ছিল ।
৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনী মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানার দিকে অগ্রসর হয়। এই সেনাবাহিনী ক্লান্ত ছিল এবং গঙ্গা নদীর কাছাকাছি বিশাল ভারতীয় বাহিনীর মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ে যায়। এই বাহিনী বিয়াসের কাছে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং আরও পূর্বদিকে যেতে অস্বীকার করে। আলেকজান্ডার তখন তার সহকারী কইনাস (Coenus) এর সাথে দেখা করার পরে ঠিক করেন ফিরে যাওয়াই ভাল।

১. মৌর্য সাম্রাজ্য

মৌর্য সাম্রাজ্য (রাজত্বকাল ৩২১-১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মগধেই গড়ে উঠেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। এই সাম্রাজ্য অশোকের রাজত্বকালে দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান অবধি বিস্তার লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্য মগধেই গড়ে ওঠে যা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাংশে এবং পারস্য এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশে বিস্তার লাভ করেছিল। চন্দ্রগুপ্ত ---> বিন্দুসার ---> অশোক।

২. গৌড় রাজ্য

বাংলা অঞ্চলের প্রথম স্বাধীন রাজা ছিলেন রাজা শশাঙ্ক যিনি ৬০৩ থেকে ৬৩৭ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু বাংলাকে শাষন করেছেন। তার সাম্রাজ্যের বিসতৃতির সঠিক ধারণা পাওয়া না গেলেও প্রাচীন বাংলা বলতে আমরা বুঝি পশ্চিম বঙ্গ যা আজকের কালকাতা আর আসাম, ত্রিপুরার কিছু অঞ্চল, বিহার, উডিস্যা ও পূর্ববাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ যা তখন গৌড় বলে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাষনামলে বাংলাভাষী অঞ্চল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি নামে পরিচিত ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন তাঁর পুত্র মানব, যিনি ৮ মাস পর্যন্ত গৌড়ের শাসনকার্য চালান। তার কিছুকাল পরই গৌড়, সম্রাট হর্ষবর্ধণ এবং কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মণ কর্তৃক দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শশাঙ্কের মৃত্যুর সাথে সাথে তার রাজবংশের পতন ঘটে এবং বাংলায় শুরু হয় এক অরাজক পরিবেশ যা ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় নামে পরিচিত।

৩. মাৎস্যন্যায় বা বাংলার অরাজক অবস্থা

গৌড় শাষক শশাংকের মৃত্যুর পর বা তার রাজ বংশের পতনের পর বাংলায় আর কোন কেন্দ্রেীয় শাষক ছিলেন না। সমগ্র বঙ্গে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছোট ছোট রাজ্যের সৃষ্টি হল যা শাষন করত কিছু অত্যাচারি দুর্বল শাষক। বঙ্গের জনগনের উপর নেমে এসেছিল সীমাহীন দুঃখ দুর্দশা। জোর যার মুল্লুক তার এই নীতিতে দেশ চলছিল। যে বা যারা জোর খাটাতে পারত সেই ছিল সেখানকার অধিপতি। অভিভাবকহীন সন্তান যেমন বেপরোয়া চলে, যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায় ঠিক তেমনি বাংলার জনগনও অভিবাবকহীন হয়ে যে যার মত করে চলতে লাগল যা ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় বলে পরিচিত। মাৎস্যন্যায়ের স্থায়ীত্বকাল ছিল ১৫০ বছর বা ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

৪. পাল রাজবংশ

মাৎস্যন্যায় সময়ের ভয়বহতা উপলব্ধি করে বাংলার জনগন গোপাল নামক এক সামন্ত রাজাকে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাজা হিসেবে গ্রহণ করেন। সেই থেকে শুরু হয় পাল রাজবংশের। গোপালই পাল রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। গোপাল রাজ বংশের শক্তিশালি দুই রাজা ছিলেন যথক্রমে ধর্মপাল (রাজত্বকাল ৭৮১-৮২১ খ্রীষ্টাব্দ) এবং দেবপাল (রাজত্বকাল ৮২১-৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ)। পাল বংশের স্থায়ীত্বকাল ছিল প্রায় ৪০০ বছর।
  1. প্রথম গোপাল (৭৫৬-৭৮১)
  2. ধর্মপাল (৭৮১-৮২১)
  3. দেবপাল (৮২১-৮৬১)
  4. প্রথম বিগ্রহপাল, মহেন্দ্রপাল ও প্রথম শূরপাল (৮৬১-৮৬৬)
  5. নারায়নপাল (৮৬৬-৯২০)
  6. রাজ্যপাল (৯২০-৯৫২)
  7. দ্বিতীয় গোপাল (৯৫২-৯৬৯)
  8. দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬৯-৯৯৫)
  9. প্রথম মহীপাল (৯৯৫-১০৪৩)
  10. নয়াপাল (১০৪৩-১০৫৮)
  11. তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৮-১০৭৫)
  12. দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০)
  13. দ্বিতীয় শূরপাল (১০৭৫-১০৭৭)
  14. রামপাল (১০৮২-১১২৪)
  15. কুমারপাল (১১২৪-১১২৯)
  16. তৃতীয় গোপাল (১১২৯-১১৪৩)
  17. মদনপাল (১১৪৩-১১৬২)

৫.  সেন রাজবংশ:

পাল রাজবংশের রাজা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে বারেন্দ্র সামন্তচক্রেরবিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করেন এবং অবশেষে বাংলার পাল রাজবংশের রাজা মদনপালের রাজত্বকালে স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশ ঘটান। বাংলায় সেন শাসনের বিশেষ তাৎপর্য এই যে, সেনগণই সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলার ওপর তাদের নিরঙ্কুশ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বাংলার সেন বংশীয় রাজাদের মধ্যে বিজয় সেন, বল্লাল সেন, ও লক্ষ্মণ সেন বিশিষ্ট স্থান অধিকার করছেন। সেন রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন হলেও মূল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন সামন্ত সেন ও হেমন্ত সেন। পরে হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেনই সেন রাজবংশের বিস্তিৃতি ঘটান। অবশেষে বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন রাজা ছিলেন সেন বংশেরেই লক্ষন সেন। এর পরই বাংলায় শুরু হয় মুসলিম শাষন।
  1. হেমন্ত সেন (১০৯৭)
  2. বিজয় সেন (১০৯৭-১১৬০)
  3. বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮)
  4. লক্ষ্মন সেন (১১৭৮-১২০৬)
  5. বিশ্বরূপ সেন (১২০৬-১২২০)
  6. কেশব সেন (১২২০-১২৫০)

৬. মুসলিম শাসন:

ভারতীয় উপমহাদেশে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের শুরু হলেও বাংলায় মুসলিম শাসন আসে ১২০৪ সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির হাত ধরে। তিনিই প্রথম ১৭ মতান্তরে ১৮ জন ঘোড় সওয়ারী সৈন্য নিয়ে তখনকার বাংলার রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করে রাজা লক্ষণ সেনকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে ও এ দেশে মুসলিম শাসনের পথ সুগম করেন।  প্রায় ৬০০ বছরের কাছাকাছি সময় অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে মুসলিম শাষন অব্যাহত ছিল।

6.1      ইলিয়াস শাহী বংশ (প্রথম পর্ব)

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) (১৩৪২ থেকে পশ্চিম বাংলার লখনৌতি রাজ্যের সুলতান এবং ১৩৫২ থেকে পুরো বাংলায়)
  1. প্রথম সিকান্দর শাহ (১৩৫৮-১৩৯০)
  2. গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১১)
  3. সাইফুদ্দীন হামজা শাহ (১৪১১-১৪১৩)
  4. মুহাম্মদ শাহ (১৪১৩)

6.2      বায়াজিদ বংশ

  1. শিহাবুদ্দিন বায়াজিদ শাহ (১৪১৩-১৪১৪)
  2. প্রথম আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৪১৪-১৪১৫)

6.3      গণেশ বংশ

  1. রাজা গণেশ (১৪১৪-১৪১৫ এবং ১৪১৬-১৪১৮)
  2. জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৫-১৪১৬ এবং ১৪১৮-১৪৩৩)
  3. শামসুদ্দীন আহমদ শাহ (১৪৩৩-১৪৩৫)

6.4      ইলিয়াস শাহী বংশ (দ্বিতীয় পর্ব)

  1. প্রথম নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-১৪৫৯)
  2. রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪)
  3. শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১)
  4. দ্বিতীয় সিকান্দর শাহ (১৪৮১)
  5. জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭)

6.5      হাবসি বংশ

  1. বারবক শাহ (১৪৮৭)
  2. সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-১৪৯০)
  3. দ্বিতীয় নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৯০)
  4. শামসুদ্দীন মুজাফ্ফর শাহ (১৪৯০-১৪৯৩)

6.6      হুসেন বংশ

  1. আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)
  2. নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩২)
  3. দ্বিতীয় আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৫৩২-১৫৩৩)
  4. গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮)

6.7      শূর বংশ

  1. শের শাহ শূরি (১৫৪০-১৫৪৫)
  2. ইসলাম শাহ শূরি (১৫৪৫-১৫৫৩)
  3. ফিরোজ শাহ শূরি (১৫৫৩)
  4. আদিল শাহ শূরি (১৫৫৩-১৫৫৭)- তাঁর শাসনকালে ১৫৫৫ সালে বাংলার শাসক মুহাম্মদ খান শূরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং 'শামসুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ' উপাধী ধারণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন।
  5. শামসুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ (১৫৫৫)
  6. প্রথম গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ (১৫৫৫-১৫৬০)
  7. গিয়াসুদ্দীন জালাল শাহ (১৫৬০-১৫৬২)
  8. দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ (১৫৬২-১৫৬৩)

6.8      কররানি বংশ

  1. তাজ খান কররানি (১৫৬৩)
  2. সুলায়মান কররানি (১৫৬৩-১৫৭২)
  3. বায়াজিদ কররানি (১৫৭২-১৫৭৩)
  4. দাউদ খান কররানি (১৫৭৩-১৫৭৬)

6.9      মুঘল আমল(১৫২৬-১৮৫৭)

  1. মুর্শিদকুলি জাফর খান ১৭০৩-১৭২৭
  2. সুজা উদ্দিন ১৭২৭-১৭৩৯
  3. সফররাজ খান ১৭৩৯-১৭৪০
  4. আলিবর্দী খান ১৭৪০-১৭৫৬
  5. সিরাজদ্দৌলা ১৭৫৬-১৭৫৭

৭. ইংরেজ শাসন:

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশির আম বাগানে ভগিরতি নদীর তীরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দোলার মৃত্যুর মাধ্যমে এ দেশে ইংরেজ শাসনের উন্মেষ হলো। মীর জাফরের মীর জাফরীর কারণে বাংলা তথা পুরো ভারতবর্ষ হারালো তাঁর স্বাধীনতা।
  1. মীরজাফর ১৭৫৭-১৭৬০
  2. মীরকাসিম ১৭৬০-১৭৬৩
  3. মীরজাফর (দ্বিতীয় বার) ১৭৬৩-১৭৬৫
  4. নাজম উদ দৌলা ১৭৬৫-১৭৬৬
  5. সইফ উদ দৌলা ১৭৬৬-১৭৭০

ব্রিটিশ শাসনের সময়ে দুটি মারাত্মক দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর বহুমানুষের জীবনহানি ঘটিয়েছিল। প্রথম দুর্ভিক্ষটি ঘটেছিল ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে এবং দ্বিতীয়টি ঘটেছিল ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে। ১৭৭০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে বাংলার দুর্ভিক্ষটি ছিল ইতিহাসের সব থেকে বড় দুর্ভিক্ষগুলির মধ্যে একটি। বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল ১৭৭০ এবং তার পরবর্তী বছরগুলিতে।
অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে, ১৯ শতক জুড়ে এবং ২০ শতকের প্রথমার্ধে সমাজ সংস্কার আন্দোলনই বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত। রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২ ১৮৩৩) হাত ধরে ১৯ শতকে এ নবজাগরণের সূচনা। ২০ এর শতকের মধ্যমাংশে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে অবসান ঘটে এ নবজাগরণের। অসংখ্য সাহিত্যিক , বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও দেশপ্রেমিকের হাত ধরে বাংলার নবজাগরণ বাংলাকে উত্তরণ করে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে।
১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শাসনের অবসান ঘটায় এবং বাংলা সরাসরি ভাবে ব্রিটিশ রাজবংশের শাসনাধীনে আসে ।

৮. দেশ বিভাজন

দীর্ঘ ১৯০ বছর (১৭৫৭) ব্রিটিশদের গোলামীর পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজন হয়ে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্থান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। ক্লিপটনের মনগড়া সীমান্ত নির্ণয়ে তৈরি হলো ভারত ও পাকিস্থানের বির্তকিত ভূখন্ড। হিন্দু-মুসলিম চলমান দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলেই এই দেশ বিভাজন।

৯. স্বাধীনতার শুরু

  1. ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন।
  2. ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও না পাওয়া।
  3. ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল লজারি করে।
  4. ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন।
  5. ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারের মুখে টিকতে না পেরে শেষাবধি ২৫ মার্চ পাকিস্তানের লৌহ মানবপ্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সারা দেশে নতুন করে জারি হয় সামরিক শাসন
  6. ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসন হতে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্যে থাকবে দু'জন প্রধানমন্ত্রী। "এক ইউনিট কাঠামো" নিয়ে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এরূপ অভিনব প্রস্তাব নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ভুট্টো মুজিবের ৬-দফা দাবি মেনে নিতেও অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন।
  7. ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।
  8. ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দিন আহমদের উপর। বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
  9. ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়। তারপরও সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। যদিও এই হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা, বাঙালি হত্যা পুরো দেশজুড়ে চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ্য। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল - জগন্নাথ হল - পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছে, তবে হামিদুর রহমান কমিশনের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করেছিলো। জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হলগুলোতে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ভিডিওটেপে ধারণ করেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনলজি (বর্তমান বুয়েট) এর প্রফেসর নূরুল উলা।
  10. ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়।
  11. ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজগুলো মাইন দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।
  12. ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে "ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।" পাঁচটা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের উদ্দেশ্যে এবং সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে প্রেরিত হয় ভারতীয় ভূখণ্ডের গভীরে আগ্রায় আঘাত করার উদ্দেশ্যে। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আক্রমণে। মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেতার বক্তৃতায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। এর আগেই বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে পরাস্ত করে ঢাকার সকল সামরিক বিমান ঘাঁটির রানওয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন উত্তরে চীন ও দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁদের জন্য সহায়তা আসবে, কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে নি।
  13. ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।



No comments:

Post a Comment