Pages

Saturday, July 5, 2014

অ-জানি দেশের না-জানি কী

এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজা বিয়ে থা করেনি, একাই থাকে। তর কাছে এক তীরন্দাজ কাজ করত। তার নাম আন্দ্রেই।
একদিন আন্দ্রেই শিকার করতে গেছে। সারাদিন বনে ঘুরে ঘুরেও তার কপাল খুলল না, শিকার মিলল না। এদিকে সন্ধা হয়ে যাচ্ছে, আন্দ্রেই বাড়ী ফিরে চলল। হঠাৎ দেখে, গাছের মাথায় একটা ঘুঘু বসে।
আন্দ্রেই ভাবলো, "ওটাকেই মারা যাক।"
আন্দ্রেই তীর মারলো পাখির ডানায়। গাছের উপর থেকে সোঁদা মাটির উপর পড়ে গেল পাখিটা। আন্দ্রেই তুলে নিয়ে গলা মুচড়ে থলিতে পুরতে যাবে, হঠাৎ পাখিটা মানুষের গলায় কথা কয়ে উঠলো।
"মের না, তীরন্দাজ আন্দ্রেই, গলা কেটে ফেলোনা। জীবন্ত বাড়ী নিয়ে জানালায় রেখে দিও। যেই ঝিমতে শুরু করব, অমনি তোমার ডান হাত দিয়ে চড় মেরো আমায়। দেখবে তোমার ভাগ্য কেমন খুলে যায়।"

নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না আন্দ্রেই : এ কী? দেখতে ঠিক পাখির মতো, আবার মানুষের মতো কথা বলে! আন্দ্রেই পাখিটা বাড়ী নিয়ে গিয়ে জানলার উপর রেখে দেখতে লাগল কী হয়

কিছুক্ষন পরে ঘুঘুটা ডানার তলায় মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুঘুটা কী বলেছিল মনে পড়ল আন্দ্রেই এর। ডান হাত দিয়ে ঘুঘুটাকে সে চড় মারল।ঘুঘুটা মাটিতে পড়ে হয়ে গেল এক কন্যে, রাজকুমারী মারিয়া। কী তার রূপ, সে রূপ বলার নয়, কওয়ার নয়, রূপকথাতেই পরিচয়।
রাজকুমারী মারিয়া তীরন্দাজকে বলল:
"হরন করলে যখন, করো ভরন পোষণ। ভোজের জন্য তাড়া নেই, বিয়ে করো। হাসিখুশি সতীলক্ষী বৌ পাবে।"
সেই কথাই ঠিক হল। তীরন্দাজ আন্দ্রেই রাজকুমারী মারিয়াকে বিয়ে করে দুজনে মনের সুখে থাকতে লাগল। আন্দ্রেই কিন্তু তার কাজ ভোলে না। রোজ সকালে আলো ফুটতে না ফুটতেই বনে গিয়ে বনমোরগ শিকার করে রাজবাড়ীর রসুইঘরে দিয়ে আসে।
এইভাবে দিন কাটে। একদিন রাজকুমারী মারিয়া বলল:
"আমরা বড় গরীবের মত দিন কাটাচ্ছি, আন্দ্রেই।"
"তা ঠিক বলেছো।"
"একশ রুবল জোগাড় করে আমায় কিছু রেশম এনে দাও, তাহলে আমাদের অবস্থা ঠিক ফেরাতে পারব।"

রাজকুমারী মারিয়া যা বলল তাই করল আন্দ্রেই। বন্ধুদের কাছে গিয়ে কারও কাছে এক রুবল, কারও কাছে দুই রুবল, এইভাবে একশ রুবল ধার করে রেশম কিনে বাড়ী ফিরল। রাজকুমারী বলল:
"এবার শুতে যাও, রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে।"
আন্দ্রেই শুতে গেল। বুনতে বসল রাজকুমারী মারিয়া। সারারাত ধরে বুনে মারিয়া এমন একটা গালিচা তৈরী করল, যা পৃথিবীতে কেউ দেখেনি। গালিচার ওপরে গোটা রাজ্যের ছবি আঁকা, শহর-গ্রাম, মাঠ-বনের নক্সা তোলা, তার আকাশে পাখি, বনে পশু, সমুদ্রে মাছ, আর সবকিছুর উপর চাঁদের আলো, রবির কিরণ...

সকালবেলা মারিয়া স্বামীকে গালিচাটা দিয়ে বলল:
"সওদাগরের হাটে গিয়ে বেচে এসো। কিন্তু দেখো নিজে মুখে দাম বলো না, যা দেবে তাই নিয়ো।"

আন্দ্রেই গালিচা হাতে ঝুলিয়ে চলল সওদাগরদের হাটে।
আন্দ্রেইকে দেখেই তক্ষুনি এক সওদাগর দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল:
"কত দাম চাও, ভাই?"
"তুমি সওদাগর, তুমিই বলো!"
সওদাগর ভেবে ভেবে আর কিছুতেই দাম বলতে পারে না। তারপর এলো আরেকজন, আরো একজন, এক এক করে ভীড় জমে গেল সওদাগরের। সকলেই গালিচাটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর অবাক হয়, কিন্তু কেউ আর দাম বলতে পারে না।

সেই সময় পথ দিয়ে যাচ্ছিল রাজার এক মন্ত্রী। কী ব্যপার দেখাবার জন্যে গাড়ী থেকে নেমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে বলল:
"নমস্কার সওদাগরেরা, সাগরপারের মানুষেরা! কী ব্যপার?"
"না, গালিচাটার দাম ঠিক করতে পারছি না।"
রাজার মন্ত্রী তো গালিচাটার দিকে তাকিয়ে হতববাক।
জিজ্ঞেস করল, "বলো তীরন্দাজ, সত্যি করে বলো তো, চমৎকার এই গালিচাটা তুমি কোথায় পেলে?"
"না, আমার বৌ বানিয়েছে।"
"কত দাম চাও তুমি?"
"আমি জানি না, বৌ বলে দিয়েছে দরাদরি কোরো না, যা দেবে তাই নেব।"
"তাহলে এই নাও দশ হাজার।"
আন্দ্রেই টাকা নিয়ে গালিচাটা দিয়ে বাড়ী ফিরে চলল। মন্ত্রী প্রাসাদে ফিরে গালিচাটা দেখাল রাজাকে।
নিজের সমস্ত রাজত্বটা চোখের সামনে মেলা দেখে রাজা তো হতভম্ভ। আহামরি করে বলে:
"যাই বলো মন্ত্রী, তোমাকে আর এ গালিচা ফিরিয়ে দিচ্ছিনে।"
কুড়ি হাজার রুবল রাজা নগদ ধরে দিলে মন্ত্রীকে। মন্ত্রী টাকা পেয়ে ভাবল : "যাকগে। আমি আর একখানা ফরমাশ দেব, এর চেয়েও সুন্দর।"

গাড়ী চড়ে মন্ত্রী চলে গেল সহরতলীতে। সেখানে তীরন্দাজ আন্দ্রেই - এর বাড়ী খুঁজে বের করে দরজায় টোকা মারতে লাগল। দরজা খুলে দিল রাজকুমারী মারিয়া। মন্ত্রী এক পা দিল চৌকাঠের ওপারে, কিন্তু অন্য পা তার আর ওঠে না। কথা সরে না মুকখে। কী জন্যে এসেছিল সব ভুলে গেল। সামনে তার এক অপুর্ব সুন্দরী কন্যা, রূপ দেখে তার আশ মেটে না।

মন্ত্রী কী বলে শোনার জন্যে রাজকুমারী মারিয়া দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু যখন দেখল মন্ত্রী একটি কথাও বলছে না, তখন মুখ ঘুরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলে। সম্বিত ফিরে এল মন্ত্রীর। বাড়ী ফিরে চলল। কিন্তু সেইদিন থেকে মন্ত্রীর খাওয়া দাওয়া গেল ঘুচে। সারাক্ষন খালি তীরন্দাজের বৌয়ের কথা ভাবে।

রাজা বেশ বুঝলে মন্ত্রীর কিছু হয়েছে, তাই একদিন জিজ্ঞেস করলে ব্যপার কী?
"কী আর বলি রাজামশাই, তীরন্দাজের বৌকে দেশে আর কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আমায় যেন যাদু করে ফেলেছে, কিছুতেই সে মায়া কাটাতে পারছি না।"

রাজা ভাবলে, "আমিও একবার তীরন্দাজের বৌকে দেখে আসি।" সধারন জামাকাপড় পরে রাজা গেল সহরতলীতে। আন্দ্রেই - এর বাড়ী খুঁজে বের করে দরজায় টোকা মারল। দরজা খুলে দিল রাজকুমারী মারিয়া। রাজা এক পা বাড়াল চৌকাঠের দিকে, কিন্তু অন্য পা আর তার ওঠেনা। মুখে আর কথা সরে না। হাঁ করে রাজা এই অপূর্ব মুখের স্বর্গীয় রূপ দেখতে লাগল।

রাজা কী বলে তার জন্য দাঁড়িয়ে রইল রাজকুমারী মারিয়া। কিন্তু রাজা যখন একটি কথাও বললে না, তখন মুখ ঘুরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ভীষন দু:খ হল রাজার। ভাবলে, "আমিই বা কেন একা থাকি। এই তো আমার উপযুক্ত এক সুন্দরী কন্যা। এমন মেয়ের রাজরানী হওয়াই সাজে, তীরন্দাজের বৌ নয়।"

প্রাসাদে ফিরে, রাজার মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি এল - স্বামী বেঁচে থাকতেও বৌ চুরি করে আনবে। মন্ত্রীকে ডেকে বলল :
"একটা উপায় বের করো মন্ত্রী, কী করে ঐ তীরন্দাজ আন্দ্রেইকে তাড়ান যায়। আমি ওর বৌকে বিয়ে করটে চাই। তুমি যদু আমায় সাহায্য করো, তবে সহর, গ্রাম, সোনাদানা অনেক কিছু উপহার দেব। আর যদি না করো তবে তোমার গর্দান যাবে।"

মন্ত্রীর ভীষন ভাবনা হলো। মাথা হেঁট করে ফিরে গেল, কিছুতেই আর আন্দ্রেইকে তড়ানোর ফন্দি বের করতে পারে না। মনের দু:খে মন্ত্রী গেল শুঁড়িখানায় মদ খেতে।
শুঁড়িখানার এক নেশাখোর, গায়ে তার ছেঁড়া কাপড় জামা, সে এসে মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে:
"মন ভার কেন রাজমন্ত্রী? মাথা হেঁট কেন?"
"দূর হ, হতভাগা কোথাকার!"
"আমায় তাড়িয়ে না দিয়ে যদি একটু মদ খায়াও, তবে খুব ভালো বুদ্ধি দিতে পারি।"
মন্ত্রী লোকটিকে এক গেলাশ মদ খাইয়ে তার দু:খের কথা খুলে বলল।
লোকটি বলল:
"কাজটি তেমন কঠিন নয়, তীরন্দাজ আন্দ্রেই তো ভারী সরল মানুষ, তবে ওর বৌ ভারী বুদ্ধিমতী, যাকগে, এমন একটা ফন্দি বের করতে হবে যাতে কিছুতেই ও পার না পায়। এক কাজ করো, বাড়ী গিয়ে রাজাকে বলো আন্দ্রেইকে হুকুম দিক পরলোকে গিয়ে ও দেখে আসুক রাজামশাইয়ের বাবা বুড়ো রাজা কেমন আছে। আন্দ্রেই একবার গেলে আর ফিরবে না।"

বদমাইশটাকে ধন্যবাদ দিয়ে মন্ত্রী ছুটে গেল রাজার কাছে।
"আন্দ্রেইকে সরিয়ে দেবার একটা উপায় বের করেছি।" বললে কোথায় পাঠাতে হবে তাকে, কী কাজে। রাজা ভীষন খুশি হয়ে তক্ষুনি তীরন্দাজ আন্দ্রেইকে ডেকে পাঠাল'

"দেখো আন্দ্রেই, তুমি আমার এতদিন ন্যায়ধম্মে কাজ করেছো। আজ আর একটি কাজ আমার করো। পরলোকে গিয়ে দেখে আসতে হবে আমার বাবা কেমন আছেন। নইলে আমার কৃপাণ, নেবে তোমার গর্দান..."

আন্দ্রেই বাড়ী ফিরে মন খারাপ করে চৌকিতে বসে রইল।
রাজকুমারী মারিয়া বলল:
"মন খারাপ কেন আন্দ্রেই, বিপদ হয়েছে কিছু?"
রাজা কী হুকম করেছে আন্দ্রেই সব কথা খুলে বলল।
রাজকুমারী মারিয়া বলল:
"এ নিয়ে এত ভাবনা? এ আবার কাজ নাকি, এত নেহাত ছেলেখেলা, আসল কাজই বাকী। যাও শোও গে, রাত পোহালে বুদ্ধি খোলে।"
পরদিন সকালে আন্দ্রেই খুম থেকে উঠতেই রাজকুমারী মারিয়া এক থলি শুকনো রুটি আর একটা সোনার আংটি দিয়ে বলল:
"রাজামশাইকে গিয়ে বলো, মন্ত্রীকে তোমার সঙ্গে যেতে হবে, তুমি সত্যিই পরলোকে গিয়েছিলে কিনা মন্ত্রী তার সাক্ষী থাকবে। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে সোনার আংটিটা সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিও, আংটি তোমায় পথ দেখিয়ে দেবে।"

বৌকে বিদায় জানিয়ে শুকনো রুটি আর আংটি নিয়ে আন্দ্রেই রাজার কাছে গিয়ে বলল মন্ত্রীকে সঙ্গে দিতে হবে, রাজা আপত্তি করতে পারল না।

মন্ত্রী আর আন্দ্রেই দুজনে পথে বেরল। আংটিটা গড়িয়ে দিল আন্দ্রেই। খোলা মঠ, পানা জলা, নদী, হ্রদ পেরিয়ে আন্দ্রেই চলল আংটির পিছু পিছু। আর আন্দ্রেই - এর পিছনে পিছনে কোনক্রমে আসে রাজমন্ত্রী।

হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে ওরা কিছু শুকনো রুটি খেয়ে নেয়, তারপর আবার হাঁটা দেয়।
অল্প দূর নাকি অনেক দূর, শেষ পর্যন্ত এসে পড়ল এক বিজিবিজি গহন বনের মধ্যে। সেখানে এক গভীর খাদের মধ্যে নেমে থেমে গেল আংটিটা।

আন্দ্রেই আর মন্ত্রী কিছু শুকনো রুটি খাবে বলে বসল। এমন সময় দেখে কি, বুড়ো থুথ্থুড়ে রাজাকে দিয়ে কাঠ বইছে দুই শয়তান। সে কাঠের ভার কী! রাজার দুই দিকে দুই শয়তান বসে লাঠি মেরে মেরে তাকে চালাচ্ছে।

আন্দ্রেই বলল:
"দেখো দেখো, রাজার মরা বাবা না?"
মন্ত্রী বলল: "তাই তো বটে! এযে দেখছি সে-ই বোঝা বইছে!"
আন্দ্রেই চিৎকার করে শয়তানদুটোকে ডেকে বলল:
"ও মশাইরা! বুড়োটাকে একবার ছেড়ে দাওনা, দুটো কথা আছে।"
শয়তানেরা বলল:
"আমাদের অত সময় নেই। নিজেরাই আমরা কাঠগুলো বয়ে নিয়ে যাব নাকি?"
"আমি তোমাদের একটা তাজা লোক দিচ্ছি, সে কিছুক্ষন বুড়োর জায়গায় কাজ করতে পারে।"
এই শুনে শয়তানদুটো বুড়োর ঘাড় থেকে জোয়ালটা খুলে মন্ত্রীর ঘাড়ে পরিয়ে দিল। তারপর লাঠি দিয়ে একজন ডাইনে মারে, একজন বাঁয়ে মারে, কুঁজো হয়ে বোঝা টানতে শুরু করল মন্ত্রী।

আন্দ্রেই তখন বুড়ো রাজাকে জিজ্ঞেস করল কেমন তার দিন চলছে।
রাজা বলল, "কী আর বলব, তীরন্দাজ আন্দ্রেই? এ জগতে এসে বড় কষ্টে দিন যাচ্ছে। ছেলেকে গিয়ে আমার কথা জানিও আর বোলো, লোকের সাথে যেন খারাপ ব্যাবহার না করে, নইলে এখানে এসে তারও দিন যাবে কষ্টে।"

কথাবার্তা শেষ হতে না হতেই শয়তানগুলো খালি গাড়ী নিয়ে ফিরে এলো। আন্দ্রেই বুড়ো রাজার কাছ থেকে বিদায় নিল, শয়তানদের কাছ থেকে মন্ত্রীকে খালাস করে বাড়ী ফিরে চলল দুজনে।

দেশে পৌঁছে ওরা প্রাসাদে গেল। রাজা আন্দ্রেইকে দেখেই ক্ষেপে আগুন।
বললে, "ফিরে এলে যে বড়! আচ্ছা আস্পর্ধা তোমার!"
"না, আপনার বাবার সঙ্গে পরলোকে দেখা করে এসেছি। বুড়ো রাজামশাইয়ের বড় কষ্টে দিন কাটছে। আপনাকে আশির্বাদ জানিয়ে খুব করে বলেছেন, প্রজার উপর যেন অত্যাচার না করেন।"

"সত্যিই যে পরলোকে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করেছো তার প্রমান কী?"
"আপনার মন্ত্রীর পিঠে শয়তানদের লাঠির দাগগুলো দেখুন।"
মোক্ষম প্রমান! রাজা আর কী করে, ছেড়ে দিলে আন্দ্রেইকে। আর মন্ত্রীকে ডেকে বললে:
"আন্দ্রেইকে সরিয়ে দেবার উপায় বের করো বাপু, নইলে আমার কৃপাণ, নেবে তোমার গর্দান।"
মন্ত্রীর এবার আরো দুশ্চিনতা। শুঁড়ীখানায় গিয়ে মন্ত্রী মদ নিয়ে বসল টেবিলে। অমনি সেই বদমাশটা হাজির। বলল:
"কিসের এত ভাবনা তোমার, রাজমন্ত্রী? আমার যদি একটু মদ খাওয়াও তবে আমি ভালো বুদ্ধি বাতলে দিতে পারি।"

মন্ত্রী তখন তাকে এক গেলাশ মদ দিয়ে সব খুলে বলল। নেশাখোরটা বলল:
"রাজাকে গিয়ে বলো আন্দ্রেইকে এক কাজ দিতে - এ বাবা জবর কাজ, দিশা পাওয়াই কঠিন, করা তো দূরের কথা। বলবে তিন নয়ের দেশ পেরিয়ে, তিন দশের রাজ্যে এক ঘুমপাড়ানী বেড়াল আছে, আন্দ্রেইকে সেটা এনে দিতে হবে..."

রাজমন্ত্রী ছুটে গিয়ে আন্দ্রেইকে সরিয়ে দেবার উপায় বলল রাজাকে। রাজা আন্দ্রেইকে ডেকে পাঠাল।

"শোন আন্দ্রেই, তুমি আমার একটা কাজ করে দিয়েছো, আর একটা কাজও করে দাও। তিন নয়ের দেশ পেরিয়ে, তিন দশের রাজ্যে গিয়ে ঘুমপাড়ানী বেড়াল নিয়ে এসো আমার জন্যে। নইলে আমার কৃপান, নেবে তোমার গর্দান।"
মাথা নীচ করে বাড়ী ফিরল আন্দ্রেই। বৌকে বলল রাজা কী কাজ দিয়েছে।
রাজকুমারী মারিয়া বলল, "এ নিয়ে এত ভাবনা? এ তো কাজ নয়, ছেলেখেলা, আসল কাজই বাকী। যাও, শোওগে, রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে।"
আন্দ্রেই ঘুমাতে গেল। রাজকুমারী মারিয়া তখন কামারের বাড়ী গিয়ে বলল তিনটে লোহার টুপি, একটা লোহার চিমটে আর তিনটে দন্ড বানিয়ে দিতে - একটা লোহার, একটা তামার আর তৃতীয়টা টিনের।
পরদিন ভোরে রাজকুমারী মারিয়া আন্দ্রেইকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলল:
"এই নাও তিনটে টুপি, একটা চিমটে আর তিনটে দন্ড - এবার তিন নয়ের দেশ পেরিয়ে তিন দশের রাজ্যে যাও। ওখানে পৌঁছবার তিন ভার্ষ্ট আগে তোমার ভীষন ঘুম পাবে - ঘুম পাড়ানী বেড়াল তোমায় ঘুম পাড়াবে। কিন্তু খবরদার, ঘুমিয়ে পড়োনা। হাত দিয়ে আড়মোড়া ভাঙবে, পা দিয়ে আড়মোড়া ভাঙবে, মাটিতে গড়াগড়িও দেবে। ঘুমিয়ে পড়লেই কিন্তু বেড়াল মেরে ফেলবে তোমায়।"

কী কী করতে হবে সব বুঝিয়ে বলে আন্দ্রেইকে বিদায় দিয়ে পাঠাল রাজকুমারী মারিয়া।
বলতে এতটুকু কিন্তু করতে এতখানি। তিন দশের রাজ্যে এসে পৌঁছুলো আন্দ্রেই। ঠিক তিন ভার্ষ্ট আগে ভীষন ঘুম পেতে লাগল তার। তখন তিনটে লোহার টুপি মাথায় পরে, হাতদিয়ে আড়মোড়া ভেঙে, পা দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে এগোয় আন্দ্রেই, দরকার মত মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে নেয়।

কোনরকমে নিজেকে জাগিয়ে রাখল আন্দ্রেই, এসে পৌঁছল একটা লম্বা থামের কাছে।
ঘুমপাড়ানী বেড়াল আন্দ্রেইকে দেখেই গরর গরর করে গর্জে উঠে থামের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ল আন্দ্রেই - এর মাথার উপর। প্রথম টুপিটা ভেঙে, দ্বিতীয় টুপিটা ভেঙে, তৃতীয়টা ভাঙতে যাবে, অমনি আন্দ্রেই বেড়ালটাকে চিমটে দিয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দন্ড দিয়ে আচ্ছা করে পেটাতে লাগল। প্রথমে মারল লোহার দন্ড দিয়ে, সেটা ভেঙে যেতে মারল তামর দন্ড দিয়ে, সেটাও যখন ভেঙে গেল তখন টিনেরটা তুলে পেটাতে লাগল।

টিনের দন্ডটা বেঁকে যায়, কিন্তু ভাঙে না। কেবল বেঁকে গিয়ে বেড়ালটার গায়ে জড়িয়ে যায়। আন্দ্রেই যত মারে বেড়ালটা তত গল্প শোনায় তাকে - পুরুতদের গল্প, যাজকদের গল্প, পুরুত বাড়ীর মেয়ের গল্প। আন্দ্রেই কিন্তু কোনো কথা না শুনে যত জোরে পারে কেবল মেরেই চলে।
বেড়াল আর পারে না। দেখে তুকতাক চলবেনা, তাই অনুনয়-বিনয় শুরু করল:
"ছেড়ে দাও সুজন, যা বলবে তাই করব।"
"আমার সঙ্গে যাবি?"
"যেখানে বলবে যাব।"
আন্দ্রেই বেড়ালটা নিয়ে বাড়ীর দিকে চলতে শুরু করল। দেশে ফিরে বেড়ালটাকে নিয়ে গেল রাজার কাছে। বলল:
"তা, হুকুম তামিল করেছি, ঘুমপাড়ানী বেড়াল নিয়ে এসেছি।"
রাজা তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে চায় না। বললে:
"তা ঘুমপাড়ানী বেড়াল, দেখাও দেখি তোমার তেজ!"
বেড়াল অমনি থাবায় শান দেয়, রাজাকে আঁচড়ায়, এই বুঝি রাজার বুক চিরে জ্যান্ত হৃৎপিন্ডটাই বের করে আনে।
ভয় পেয়ে গেল রাজা:
"থামাও ওকে বাপু তীরন্দাজ আন্দ্রেই।"
আন্দ্রেই বেড়ালটাকে শান্ত করে খাঁচায় পুরল, নিজে ফিরে গেল রাজকুমারী মারিয়ার কাছে। দুটিতে মনের আনন্দেই থাকে। রাজার বুকের মধ্যে আরো বেশি জ্বালাপোড়া। একদিন মন্ত্রীকে ডেকে বললে:
"যেকরে পারো, উপায় বের করো, তীরন্দাজ আন্দ্রেইকে সরাও। নইলে আমার কৃপাণ, নেবে তোমার গর্দান।"

রাজমন্ত্রী সোজা গেল শুঁড়িখানায়। ছেঁড়া জামা পরা সেই বদমাশটাকে খুঁজে বার করে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবার জন্য সাহায্য চাইল। বদমাশটা টার মদের গেলাশ উজাড় করে গোঁফ মুছে বললে:
"রাজাকে গিয়ে বলো, আন্দ্রেইকে অ-জানি দেশ থেকে না-জানি কী নিয়ে আসুক। এ কাজ আন্দ্রেই সারা জীবনেও করতে পারবে না, ফিরেও আর আসবে না।"
ছুটে গিয়ে রাজাকে সব বলল মন্ত্রী। রাজা আন্দ্রেইকে ডেকে পাঠালে:
"তুমি আমায় দুটো কাজ করে দিয়েছো, এবার তৃতীয় কাজটাও করো। অ-জানি দেশ থেকে না-জানি কী-কে নিয়ে এসো। যদি পারো, রাজার মতই খেলাৎ করব। নইলে আমার কৃপাণ, নেবে তোমার গর্দান।"
আন্দ্রেই বাড়ী ফিরে চৌকিতে বসে কাঁদতে লাগল।
রাজকুমারী মারিয়া বলল:
"কী গো, এমন মনভার মেন গো? আবার কোন বিপদ নাকি?"
আন্দ্রেই বলল, "কী ার বলি, তোমার রূপই আমার কাল হলো। রাজা হুকুম করেছেন অ-জানি দেশ থেকে না-জানি কী আনতে হবে।"
"হ্যাঁ, এটা একটা কাজের মতো কাজ বটে! কিন্তু কিছু ভেবো না। শোও গে যাও, রাত পোয়ালে বুদ্ধি খোলে।"







রাত হতেই রাজকুমারী মারিয়া খুলে বসল তার যাদুর বই। পড়ে পড়ে তারপর বই ফেলে মাথায়হাত দিয়ে বসল : রাজামশাইয়ের কাজটার কথা বইয়ে কিছুই লেখা নেই। তখন রাজকুমারী মারিয়া অলিন্দে গিয়ে রুমাল বের করে নাড়তে লাগল। অমনি উড়ে এল যত পাখি, ছুটে এল যত পশু।

রাজকুমারী মারিয়া বলল:
"বনের পশু, আকাশের পাখি বলো তো! পশু - তোমরে সব জায়গায় চরে বেড়াও, পাখি - তোমরা সব জায়গায় উড়ে বেড়াও। শোননি কখনো কী করে অ-জানি দেশে গিয়ে না-জানি কী আনা যায়?"
পশুপাখির দল বলল:
"না রাজকুমারী, আমরা সে কথা শুনিনি।"
আবার রুমাল নাড়ল রাজকুমারী মারিয়া। পশুপাখির দল নিমেষের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। রাজকুমারী তৃতীয়বার রুমাল নাড়তেই এসে দাঁড়াল দুই দৈত্য।
"কী আজ্ঞা, কী হুকুম?"
"বিশ্বাসী দাসেরা আমার, নিয়ে চলো আমায় মহা সমুদ্রের মাঝখানে।"

দৈত্যদুটো রাজকুমারী মারিয়াকে ধরে মহাসমুদ্রের ঠিক মাঝখানে নিয়ে গেল গভীর জলের ওপর। রাজকুমারী মারিয়া একবার রুমাল নাড়তেই সমুদ্রের যত মাছ, যত প্রানী সব এসে হাজির।
"সমুদ্দুরের মাছ, সমুদ্দুরের প্রানী, তোমারা সবখানে সাঁতরে বেড়াও, সব দ্বীপে যাও, শোননি কখোনো কী করে অ-জানি দেশে গিয়ে না-জানি কী আনা যায়?"
"না রাজকুমারী, আমরা সে কথা শুনিনি।"
মুষড়ে পড়ল রাজকুমারী মারিয়া। দৈত্য দুটোকে বলল বাড়ী নিয়ে যেতে। দৈত্য দুটো তাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে নালিয়ে দিল বাড়ীর অলিন্দে।

পরদিন সকালে আন্দ্রেইকে বিদায় দেবার জন্য রাজকুমারী মারিয়া তাড়াতাড়ি ঘুম ছেড়ে উঠল। তারপর আন্দ্রেইকে এক সুতোর গোলা আর একটা নক্সাকাটা গামছা দিয়ে বলল:
"সামনে এই সুতোর গোলা গড়িয়ে দেবে। ওটা যে দিকে গড়াবে সে দিকে যেও। আর যেখানেই থাকো হাতমুখ ধোবার সময় পরের গামছায় মুছোনা, আমার গামছায় মুছো।"

আন্দ্রেই রাজকুমারী মারিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চারিদিকে নমস্কার করে সহরের ফটক পার হলো। তারপর সুতোর গোলা গড়িয়ে দিল সামনে। সুতোর গোলা গড়ায়, আন্দ্রেইও পিছন পিছন যায়।
বলতে এতটুকু কিন্তু করতে এতখানি। চলতে চলতে আন্দ্রেই কত রাজ্য, কত আজব দেশ পেরিয়ে গেল। সুতোর গোলা গড়াতে গড়াতে ছোট হয়ে ক্রমে একেবারে মুরগীর ডিমের মতো হয়ে গেল। তারপর এতো ছোট হয়ে গেল যে আর চোখেই পড়েনা... আন্দ্রেই তখন একটা বনের কাছে এসে দেখে মুরগীর পায়ের উপর একটা ছোট কুঁড়েঘর।

আন্দ্রেই বলল, "কুঁড়েঘর, ও কুঁড়েঘর, বনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াও তো!"
কুঁড়েঘর ঘুরে গেল। আন্দ্রেই ঘরে ঢুকে দেখে, এক পাকাচুলো বুড়ী ডাইনী বেন্ঞিতে বসে হবে টাকু ঘোরাচ্ছে।
"হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ, রুশীর গন্ধ পাঁউ! কখনো চোখে দেখিনি যারে, সে দেখি এল আমার দ্বারে। জ্যান্ত তোকে ভেজে খাব, হাড়ে চড়ে ঘুরে বেড়াব।"
আন্দ্রেই বলল:
"হয়েছে, হয়েছে বুড়ী বাবা-ইয়াগা। হঠাৎ ভবঘুরেকে খাওয়ার শখ কেন? ভবঘুরেরতো কেবল হাড্ডি-চামড়াই সার। আগে চানের জল গরম করো, ধোয়াও, চান করাও, তারপর খেও।"
বাবা-ইয়াগা তো চানের আগুন জ্বেলে জল গরম করলো। আর আন্দ্রেই গা ধুয়ে বেরিয়ে এল বৌয়ের দেওয়া গামছায় গা মুছতে মুছতে।
বাবা-ইয়াগা জিজ্ঞেস করল:
"এ গামছা তুমি পেলে কি করে? এ যে দেখি আমার মেয়ের হাতের নক্সা তোলা!"
"তোমার মেয়েই যে আমার বৌ। সেই আমাকে গামছাটা দিয়েছে।"
"ও তাই নাকি বাছা! এসো এসো, তুমি যে আমার কত আদরের জামাই!"

বাবা-ইয়াগা তাড়াতাড়ি ব্যাস্ত হয়ে কত রকম খাবার, কত রকম পানীয়, কত রকমের সব ভালো ভালো জিনিষ টেবিলের উপর সাজিয়ে দিল। আন্দ্রেই কোন ভণিতা না করেই খাবার কাজে লেগে গেল। বাবা-ইয়াগা পাশে বসে বসে নানা প্রশ্ন করতে লাগল কী করে আন্দ্রেই রাজকুমারী মারিয়াকে বিয়ে করল, তারা বেশ সুখেস্বচ্ছন্দে আছে কিনা। আন্দ্রেই সব কথা তাকে জানাল।তারপর রাজা যে তাকে অ-জানি দেশের না-জানি কী আনতে পাঠিয়েছে সে কথাও বলল।
আন্দ্রেই বলল, "তুমি যদি আমায় একটু সাহায্য করতে বুড়ী।"
"কী আর বলব বাছা, হায় হায়, এমন তাজ্জবের তাজ্জব, আমিও কখনো শুনিনি। ও কথা জানে কেবল এক বুড়ী ব্যাঙ। সে আগ তিনশ বছর হলো জলায় বাস করছে... যাকগে, কিছু ভেবনা, শুতে যাও, রাতপোয়ালে বুদ্ধি খোলে।"

আন্দ্রেই শুয়ে পড়ল আর বাবা-ইয়াগা দুটো বার্চ গাছের ঝাঁটা নিয়ে উড়ে চলে গেল সেই জলার কাছে। সেখানে গিয়র ডেকে বলল:
"ঘাঙর-ঘাঙ, বুড়ী ব্যাঙ, বেঁচে আছো?"
"আছি।"
"বেরিয়ে এসো জলা থেকে।"
জলার ভতর থেকে বেরিয়ে এলো বুড়ী ব্যাঙ। বাবা-ইয়াগা বলল:
"না-জানি কী কোথায় জানো কি?"
"জানি।"
"তাহলে দয়া করে বলে দাও কোথায়? আমার জামাইকে রাজা অ-জানি দেশ থেকে না-জানি কী আনতে পাঠিয়েছেন।"
বুড়ী ব্যাঙ বলল:
"আমি নিজেই তাকে নিয়ে যেতুম, কিন্তু ব্ডড বুড়ো হয়ে পড়েছি। অতটা লাফের সাধ্যি নেই। তোমার জামাইকে বলো আমায় এক ভাঁড় টাটকা দুধের মধ্যে করে নিয়ে যাক জ্বলন্ত নদীতে। তখন বলবো।"
বাবা-ইয়াগা ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ বুড়ী ব্যাঙকর নিয়ে উড়ে এল বাড়ী। আক ভাঁড় টাটকা দুধ দুইয়ে বুড়ী ব্যাঙকে তার মধ্যে রাখল। পরদিন খুব ভোরে আন্দ্রেইকে তুলে দিয়ে বলল:
"তা, জামাই তৈরী হয়ে নাও, টাটকা দুধের ভাঁড়টা ধরো,এতে বুড়ী ব্যাঙ আছে। আমার ঘোড়ায় চড়ে চলে যাও জ্বলন্ত নদীতে। সেখানে ঘোড়াটা ছেড়ে দিয়ে বুড়ী ব্যাঙকে ভাঁড় থেকে বের কোরো। বুড়ী ব্যাঙ তোমায় সব বলে দেবে।"

আন্দ্রেই তৈরী হয়ে ভাঁড়টা হাতে নিল, তারপর বাবা-ইয়াগার ঘোড়ায় চড়ে রওনা দিল। অনেক দিন, নাকি অল্প দিন, শেষ পর্যন্ত জ্বলন্ত নদীর কাছে পৌঁছলো আন্দ্রেই। সে নদী লাফিয়ে পেরবে এমন জন্তু নেই, উড়ে যাবে এমন পাখি নেই।

আন্দ্রেই ঘোড়া থেকে নামতে বুড়ী ব্যাঙ বলল:
"এবার বাছা, আমায় ভাঁড় থেকে বের করে নাও। নদী পেরতে হবে।"
আন্দ্রেই বুড়ী ব্যাঙকে ভাঁড় থেকে বের করে মাটিতে রাখলো।
"এবার সুজন, আমার পিঠে চড়ে বসো।"
"সেকি দিদিমা! তুমি যে এতটুকু! আমার চাপে পিষে যাবে।"
"ভয় নেই, কিছু হবে না, ভালো করে ধরে থেকো।"
বুড়ী ব্যাঙের পিঠে চেপে বসল আন্দ্রেই। ব্যাঙ অমনি নিজেকে ফোলাতে শুরু করল। ফুলতে ফুলতে একটা বিচালির আঁটির মতো বড় হয়ে উঠল ব্যাঙ।
"চেপে ধরেছো তো শক্ত করে?"
"হ্যাঁ দিদিমা, ধরেছি।"
আবার ফুলতে শুরু করলো ব্যাঙ। ফুলতে ফুলটে বড়ো হয়ে গেল একটা বিচালির গাদার মতো।
"চেপে ধরেছো তো শক্ত করে?"
"হ্যাঁ দিদিমা, ধরেছি।"
আবার ফুলতে শুরু করলো ব্যাঙ। ফুলতে ফুলতে এবার সে ঘন বনের চেয়েও উঁচু হয়ে গেল।
তারপর এক লাফে একেবারে জ্বলন্ত নদীর ওপারে। ওপারে গিয়ে আন্দ্রেইকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়ে সে আবার আগে মতো ছোটটি হয়ে গেল।

"চলে যাও সুজন, এই পায়ে হাঁটা পথ ধরে, দেখবে এক কোঠা বাড়ী - অথচ কোঠা নয়, কুঁড়েঘর - অথচ কুঁড়ে নয়, চালা - অথচ চালা নয়। গিয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে চুল্লীর পিছনে দাঁড়িয়ে থেকো। সেখানেই পাবে না-জানি কী।"

পথ ধরে চলল আন্দ্রেই, দেখে এক পুরোনো কুঁড়েঘর - কিন্তু কুঁড়ে নয়। জানালা নেই, অলিন্দ নেই, বেড়া দিয়ে ঘেরা। আন্দ্রেই ভিতরে ঢুকে চুল্লীর পিছনে লুকিয়ে রইল।

একটু পরেই বনের মধ্যে হুড়মুড় ঘড়ঘড় শব্দ। ঘরে এসে ঢুকল এক বুড়ো আঙ্গুলে দাদা, তার দাড়ি সাদা সাদা। ঢুকেই চীৎকার করে উঠল:
"ওহে নাউম বেয়াই, খেতে দাও!"

মুখ থেকে কথা খসতে না খসতেই শূন্যি থেকে একটা টেবিল এসে হাজির। টেবিলের ওপর এক পিপে বিয়র আর আকটা রোষ্ট করা ধারো ছুরি বেঁধানো আস্ত ষাঁড়। দাড়ি শাদা-শাদা বুড়ো আঙ্গুলে দাদা, ষাঁড়টার সামনে বসে ধারালো ছুরিটা বের করে মাংস কাটে, রসুন ঘষে, খায় দায়, তারিফ করে।
ষাঁড়টার আপাদমস্তক শেষ করল সে, বিয়রের পিপে খালি করে দিল। বলল:
"ওহে নাউম বেয়াই, এঁটো পরিষ্কার করে নাও।"
অমনি সঙ্গে সঙ্গে হাড়গোড়, বিয়রের পিপে শুদ্ধ কোথায় মিলিয়ে গেল টেবিলটা... বুড়ো আঙ্গুলে দাদা কতক্ষনে বেরিয়ে যায় আন্দ্রেই সেই অপেক্ষায় রইল। তারপর বেরিয়ে যেতেই চুল্লীর পিছন থেকে বেরিয়ে এসে ভরসা করে ডেকেই ফেলল:
"নাউম বেয়াই, আমায় কিছু খেতে দাও..."

কথাটা মুখ থেকে বেরতেই না বেরতেই কোত্থেকে যেন একটা টেবিল এসে গেল। আর তার উপর কত রকম খাবার দাবার, মধু মদ।

আন্দ্রেই টেবলে বসে বললে:
"নাউম বেয়াই, তুমিও বস, একসাথে খাওয়া যাক।"

কাউকে দেখা গেল না, কিন্তু উত্তর এল:
"ধন্যবাদ তোমায়, সুজন! কত বছর ধরে এখানে কাজ করছি, কিন্তু কেউ কোন দিন আমায় একটুকরো পোড়া রুটিও খেতে দেয়নি। আর তুমি আমাকে টেবিলে খেতে ডাকলে!"


আন্দ্রেই তো হতবাক! কাউকে দেখা যাচ্ছে না অথচ খাবার গুলো যেন ঝেঁটিয়ে সাফ হচ্ছে। আপনা থেকেই মদ আর মধুতে গেলাশ ভরে উঠছে। আপনা থেকেই খুটখুট করছে গেলাশ।
আন্দ্রেই বলল:
"নাউম বেয়াই, একবার দেখা দাও না!"
"না, আমাকে তো দেখা যায় না। আমি হলাম না-জানি কী।"
"নাউম বেয়াই, তুমি আমার কাছে কাজ করবে?"
"করব না কেন? দেখছি, লোকটা তুমি ভালো।"
খাওয়া শেষ হলে আন্দ্রেই বলল:
"টেবিলটা পরিষ্কার করে চলো আমার সঙ্গে।"
কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে আন্দ্রেই আশেপাশে তাকাল।
"নাউম বেয়াই, আছোতো এখানে?"
"হ্যঁ, আছি, ভয় নেই। তোমায় আমি ছেড়ে যাব না।"
হাঁটতে হাঁটতে আন্দ্রেই এসে পৌঁছুল জ্বলন্ত নদীর পাড়ে। সেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল ব্যাঙ।




"কী সুজন? না-জানি কী পেলে?"
"পেয়েছি দিদিমা।"
"এবার তবে আমার পিঠে চড়ে বসো।"

আন্দ্রেই পিঠে চড়ে বসল আর ব্যাঙ নিজেকে ফোলাতে শুরু করল আবার। তারপর এক লাফে আন্দ্রেইকে জ্বলন্ত নদী পার করে দিল।
আন্দ্রেই ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ বুড়ী ব্যাঙকে ধন্যবাদ দিয়ে নিজের দেশের পথ ধরল। আন্দ্রেই একটু যায় আর মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে:
"কি নাউম বেয়াই, আছো তো?"
"আছি আছি, কোন ভয় নেই তোমার। ছেড়ে যাব না।"
আন্দ্রেই হাঁটে আর হাঁটে। দুরের পথ। এলিয়ে পড়ে তার সবল পা, নেতিয়ে পড়ে তার ধবল হাত।
বলে: "ওহ! কী ক্লান্তই না হয়ে পড়েছি!"
নাউম বেয়াই বলল:
"আগে বললে না কেন? আমি তোমায় পলকের মধ্যে বাড়ী পৌঁছে দিতুম।"
হঠাৎ একটা ঝড় এসে আন্দ্রেইকে পাহাড়, পর্বত, বন, শহর, গ্রাম পেরিয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলল। এক গভীর সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় আন্দ্রেই ভয় পেয়ে বলল:
"নাউম বেয়াই, একটু বিশ্রাম করতে পারলে হত!"

অমনি থেমে হেল হাওয়া। আন্দ্রেই নামতে লাগল। দেখে কি, যেখানে নীল ঢেউ গজরাচ্ছিল, সেখানে একটা দ্বীপ হয়ে গেছে। সে দ্বীপে এক সোনার ছাদওয়ালা প্রাসাদ আর তার চারদিক ঘিরে অপরূপ এক বাগান... নাউম বেয়াই আন্দ্রেই বলল:
"বিশ্রাম করো গে, চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খাও আর সমুদ্রের দিকে নজর রাখো। তিনটে সওদাগরী জাহাজ আসবে। তাদের নেমন্তন্নে ডেকো, ভালো করে আপ্যায়ন কোরো। ওদের কাছে তিনটে আজব জিনিষ আছে, চেয়ে নিও। তার বদলে আমায় দিয়ে দিও। ভয় নেই, আমি আবার ফিরে আসব।"

অনেকদিন নাকি অল্পদিন, দেখে কি, তিনটে জাহাজ পশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে আসছে। নাবিকরা দেখে একটা দ্বীপ, তার মধ্যে অপরূপ বাগানে ঘেরা সোনার ছাদওয়ালা এক প্রাসাদ।
ওরা বলাবলি করল, "কী আশ্চার্য! কতবার গেছি এই পথে, নীল ঢেউ ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি তো! চলে জাহাজ তীরে ভেড়াই।"
জাহাজ তিনটি নোঙ্গর ফেললো। আর তিনজন সওদাগর ডিঙি করে এগিয়ে এলো পাড়ের দিকে। তীরন্দাজ আন্দ্রেই আগেই সেখানে অভ্যর্থনার জন্য হাজির।

"আসুন, আসুন অতিথি সজ্জন।"
সওদাগরেরা যত দেখে তত অবাক হয়। আগুনের মত জ্বলছে পুরীর ছাদ। গাছে গাছে পাখির গান, পথে পথে অপরূপ সব প্রানী।
"বলোতো সুজন! কে এখানে এমন আশ্চার্য প্রাসাদ বানালে?"
"আমার চাকর নাউম বেয়াই এ সবই বানিয়েছে এক রাতের মধ্যে।"
আন্দ্রেই অতিথীদের নিয়ে গেল পুরীর ভেতরে। বলল:
"ওহে নাউম বেয়াই, আমাদের কিছু খেতে দাও তো।"
হঠাৎ শুন্য থেকে একটা টেবিল এসে দাঁড়ালো। আর তার উপর নানা রকম আশ্চার্য রকম চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পানীয়। যা মন চায় সব। সওদাগরেরে একেবারে অবাক। বলল:
"এসো আমরা বদলাবদলি করি। তোমার চাকরটিকে আমাদের দাও, তার বদলে আমাদের যে কোন একটা আজব জিনিষ তুমি চাও দেব।"
"বেশ, তা কী কী আজব জিনিষ তোমাদের আছে?"
এক সওদাগর জামার নীচ থেকে একটা মুগুর বের করল। কেবল বলতে হবে, "দে তো মুগুর হাঁড় গুঁড়িয়ে।" ব্যাস, অমনি মুগুর লেগে যাবে কাজে। যতো বড়ো পালোয়ানই হোক না কেন, তার হাঁড় গুঁড়িয়ে দেবে।

আরেক সওদাগর পোষাকের নীচ থেকে বের করল একটা কুড়ুল। সোজা করে কুড়ুলটাকে দাঁড় করিয়ে রাখা মাত্রই খটাখট ঘা পড়তে লাগল আর তৈরী হয়ে গেল একটা জাহাজ। খটাখট খাটাখট - হয়ে গেল আর একটা জাহাজ। একেবারে পালতোলা, কামান লাগানো, মাঝিমাল্লায় ভরা। জাহাজগুলো চলতে শুরু করল, কামানে তোপ পড়ল, মাঝিমাল্লারা হুকুম চাইল।
সওদাগর কুড়ুলটা উল্টে রাখা মাত্র জাহাজ-টাহাজ সব মিলিয়ে গেল। যেন কিছুই ছিল না।
এবার তৃতীয় সওদাগর পকেট থেকে একটা বাঁশী বের করে বাজাতে লাগল, অমনি এক দল সৈন্য এসে হাজির, তাদের কেউ সওয়ারী, কেউ পদাতিক, কারো হাতে বন্দুক, কারো কাছে কামান। কুঁচকাওয়াজ শুরু হয়ে গেল, তুরীভেরী বেজে উঠলো, আকাশে উড়ল পতাকা, ঘোড়সওয়ারেরা হুকুম চাইল।
সওদাগর তারপর বাঁশীর অন্য মুখে ফুঁ দিতেই, ব্যাস, ভোঁ ভাঁ - মিলিয়ে গেল সব।

তীরন্দাজ আন্দ্রেই বলল:
"তোমাদের আজব জিনিষ গুলো ভালোই, তবে আমারটার দাম আরো বেশী। আমার চাকর, নাউম বেয়াইকে বদলি করতে পারি যদি তোমরা ঐ তিনটে জিনিষই আমায় দিয়ে দাও।"
"একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না ভাই?"
"নয়তো বদলি করবো না, বুঝে দেখো।"
সওদাগরেরে ভেবে দেখল: "মুগুর, কুড়ুল, বাঁশী দিয়ে আমাদের কীই বা হবে? তার বদলে নাউম বেয়াই পেলেই ভালো। রাতে দিনে খাওয়া দাওয়ার কোনো ভাবনাই থাকবে না।"

সওদাগরেরা আন্দ্রেইকে মুগুর, কুড়ুল, বাঁশি দিয়ে দিল। তারপর চীৎকার করে বলল:
"ওহে নাউম বেয়াই, আমরা তোমায় নিয়ে যাব। ধম্মমতে কাজ করবে তো?"
আওয়াজ শোনা গেল: "করবনা কেন? যার কাছেই কাজ করি আমার কাছে সবই সমান।"
সওদাগরেরা তখন জাহাজে ফিরে গিয়ে ফুর্তি জমাল। খায়-দায়, আর কেবলি হুকুম দেয়: "নাউম বেয়াই, এই আনো, সেই আনো!"
শেষ পর্যন্ত তারা বেদম মাতাল হয়ে যেখানে ছিল সেখানেই ঢুলে পড়ল।
ওদিকে তীরন্দাজ আন্দ্রেই প্রাসাদে একা বসে বসে মন খারাপ করে আর ভাবে, "হায় হায়! কোথায় গেল আমার সেই অনুগত চাকর নাউম বেয়াই?"

"এই যে আমি, কী চাই?"
আন্দ্রেই তো মহা খুশি!
"বাড়ী ফেরার সময় হয়েছে, ঘরে আমার কচি বউ! নাউম বেয়াই, একবার বাড়ী নিয়ে চল।"
আবার একটা ঝড় উঠল আর আন্দ্রেইকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলল একেবারে তার নিজের দেশে।
এদিকে তো ঘহুম থেকে উঠে সওদাগরদের গা ম্যাজম্যাজ করে, তেষ্টায় ছাতি ফাটে।
"এহে নাউম বেয়াই, দেখি, কিছু খাবার দাবার এনে দাও তো, একটু চাঙ্গা করে দাও।"
কত হাঁক আর ডাক, কিছুতেই কিছু হয় না। তাকিয়ে দেখে, দ্বীপ কোথায় মিলিয়ে গেছে। চারদিকে কেবল ফুননসে ওঠা নীল ঢেউ।
সওদাগরেরা ভীষন চটে গেল, "আচ্ছা বদ লোক তো! আমাদের এমন করে ঠকালো!" কিন্তু তখন আর উপায় নেই, পাল খাটিয়ে যেদিকে যাবার সেদিকে গেল।
তীরন্দাজ আন্দ্রেই এদিকে দেশে গিয়ে তার কুঁড়েঘরটার পাশে নামল। কিন্তু দেখে কী, কোথায় তার কুঁড়ে ঘর, একটা পোড়া কালো চিমনী ছাড়া কিছুই নেই সেখানে।
দু:খে মাথা নীচু করে সে শহর ছেড়ে চলে গেল নীল সমুদ্রের ধারে এক বিজন জায়গায়, সেখানে বসে আছে তো আছেই। হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এল একটা ঘুঘু। ঘুঘুটা মাটি ছুঁতেই হয়ে গেল আন্দ্রেই এর বৌ - রাজকুমারী মারিয়া।

দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কত কথা, কত কুশল, সবকিছু শুধোয়, সবকিছু বলে।
রাজকুমারী মারিয়া বলল:
"যেদিন থেকে তুমি বাড়ী ছেড়ে গেছো, সেদিন থেকে আমি বনে বনে ঝোপে ঝোপে ঘুঘু হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। তিন তিন বার রাজা আমার খোঁজে লোক পাঠিয়েছে। আমায় খুঁজে না পেয়ে বাড়ীটাই পুড়িয়ে দিয়েছে।"
আন্দ্রেই বলল:
"নাউম বেয়াই, নীল সমুদ্রের পাড়ে একটা প্রাসাদ তৈরী করে দিতে পারো?"
"কেন পারব না? নিমিষেই করে দিচ্ছি।"
চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই প্রাসাদ একেবারে তৈরী। আর সে কী জমকালো প্রাসাদ, রাজপ্রাসাদের চেয়েও ঢের ভালো। চারদিকে সবুজ বাগান। গাছে গাছে পাখীর গান, পথে পথে কত অপরূপ প্রানী।
তীরন্দাজ আন্দ্রেই আর রাজকুমারী মারিয়া ঢুকলো প্রাসাদে। জানলার পাশে বসে তারা দুহ-দোঁহা গল্প করে, দেখে দেখে আর আশ মেটেনা। এইভাবে মহা আনন্দে দিন কাটে, এক দিন যায়, দু-দিন যায়, তিনদিন যায়।

রাজা ওদিকে শিকার করতে গিয়ে দেখে, নীল সমুদ্রের ধারে আগে যেখানে কিচ্ছু ছিলো না, সেখানে এক মস্ত প্রাসাদ।
"আমার অনুমতি না নিয়ে কোন হতভাগা আমারই জমিতে বাড়ী তুলেছে?"
"তক্ষুনি দূত ছুটল। খোঁজখবর নিয়ে জানাল সেই যে তীরন্দাজ আন্দ্রেই, সে এই প্রাসাদ বানিয়ে তার বৌ রাজকুমারী মারিয়াকে নিয়ে বসবাস করছে।
রাজা গেল আরো ক্ষেপে, দূত পাঠাল খবর আনতে সত্যিই আন্দ্রেই অ-জানি দেশে গিয়ে না-জানি কী এনেছে কি না।

আবার দূত ছুটল। ফিরে এসে খবর দিলো :
"হ্যাঁ, মহারাজ, আন্দ্রেই সত্যিই অ-জানি দেশে গিয়ে না-জানি কী এনেছে।"
এই কথা শুনে তো রাজা একেবারে রেগে আগুন, তেলে বেগুন। তক্ষুনি সৈন্যসামন্ত ডেকে পাঠিয়ে হুকুম দিলেন সমুদ্রের তীরে গিয়ে আন্দ্রেই এর প্রাসাদ যেন ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়। তীরন্দাজ আন্দ্রেই আর রাজকুমারী মারিয়াকে যেন হত্যা করে হয় নিষ্ঠুর ভাবে।

আন্দ্রেই দেখে, প্রবল এক সৈন্যবাহিনী তাকে আক্রমন করতে আসছে। তক্ষুনি সে কুড়ুলটা টেনে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। কুড়ুল চলল খাটাখট খটাখট - অমনি জাহাজ ভাসল সমুদ্রে। খটাখট খটাখট - অমনি আর একটা জাহাজ। একশ বার কুড়ুক চলল, একশ জাহাজ পালতুলে দাঁড়াল সমুদ্রে।

আন্দ্রেই বাঁশিটা বের করে বাজাতেই হাজির হল সৈন্যদল। তাদের কেউ সওয়ারী, কেউ পদাতিকম কারো হাতে বন্দুক, কারো কাছে কামান, কারো কাছে নিশান।
সেনাপতিরা ঘোড়া ছুটিয়ে আসে, হুকুমের জন্য দাঁড়ায়। আন্দ্রেই হুকুম দিল যুদ্ধ শুরু করো। অমনি তুরী-ভেরী-কাড়া-নাকাড়া রণবাদ্য বেজে উঠলো। এগোতে শুরু করল সৈন্যদল। পদাতিকেরা ছারখার করে রাজসৈন্য। ঘোড়সওয়ারেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দী করতে থাকে। একশ জাহাজের কামান থেকে গোলা ছোটে।
রাজা দেখল, সৈন্যরা তার রণে ভঙ্গ দি্য়ে পালাচ্ছে, নিজেই ছুটল তাদের থামাতে।

আন্দ্রেই তখন তার মুগুরটা বের করে বলল:
"দে মুগুর রাজার হাঁড় গুড়িয়ে!"
অমনি মুগুর তিড়িং করে লাফিয়ে মাঠ পেরিয়ে ধেয়ে গেল। রাজাকে ধরে ফেলে তার কপালে এমন এক ঘা কষিয়ে দিল যে রাজা সেখানেই লুটিয়ে পড়ল প্রান হারিয়ে।

অমনি যুদ্ধ থেমে গেল। শহরের সব লোকেরা বেরিয়ে এসে তীরন্দাজ আন্দ্রেইকে তাদের রাজা হতে মিনতি করতে লাগল।
আন্দ্রেইও আপত্তি করল না। বিরাট এক ভোজ দিয়ে রাজকুমারী মারিয়াকে নিয়ে সারা জীবন সুখেস্বাচ্ছন্দে রাজত্ব করতে লাগলো সে।

No comments:

Post a Comment