Pages

Monday, February 24, 2025

সাত বছরের মেয়ে - সুখলতা রাও

দুই ভাই বেরোল দেশ বেড়াতে। তাদের মধ্যে এক ভাই গরীব, অন্য জনের অবস্থা ভাল। দুজনের একটা করে ঘোড়া ছিল; গরীবের ছিল মাদী ঘোড়া, বড় লোকের ছিল মস্ত তেজী ঘোড়া আর গাড়ি। রাত্রি হলে বিশ্রাম করবার জন্য তারা থামল এক জায়গায়।

রাত্রি বেলা গরীব ভাইয়ের ঘোড়ীর এক বাচ্চা হল। বাচ্চাটা গড়িয়ে চলে গেল বড়লোক ভাইয়ের গাড়ির নিচে। পরদিন সকালে বড়লোক ভাই গরীব ভাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলল, ওঠ ওঠ ভাই, দেখ রাত্রে আমার গাড়ীর কেমন বাচ্চা হয়েছে! অন্য ভাই উঠে এসে দেখে বলল, গাড়ীর কি বাচ্চা হয়? ওটা নিশ্চয় আমার ঘোড়ীর বাচ্চা।

তোমার ঘোড়ীর বাচ্চা হয়ে থাকলে তো বাচ্চাটা তার কাছে শুয়ে থাকত।

এই নিয়ে দুই ভাইয়ের ভিতরে লাগল ঝগড়া। তারা গেল আদালতে বিচার চাইতে। বড়লোক ভাই বিচারককে অনেক টাকা ঘুষ দিল।

গরীব ভাই টাকা কোথায় পাবে? সে কেবল সত্যি কথাটা বলল।

শেষটায় ব্যাপারটা গিয়ে পৌঁছুল রাজার কাছে। রাজা দুই ভাইকে ঠেকে পাঠিয়ে বললেন, আগে তোমাদের চারটা হেঁয়ালি বলব। তোমরা হেঁয়ালি চারটের উত্তর বের করে আমাকে বলবে।

হেঁয়ালি চারটি হচ্ছে- কোন জিনিস সবচেয়ে বলবান এবং দ্রতগামী?

সবচেয়ে মোটা কি?

কোন জিনিস সবচেয়ে নরম?

আর কোন জিনিস সকলের চেয়ে প্রিয়?

রাজা তাদের তিন দিন সময় দিলেন ভাবতে। তিনি বললেন চতুর্থ দিন এসে আমাকে উত্তর শোনাবে।


বড়লোক ভাই খানিক ভেবে নিয়ে তার গুরুমার কাছে গেল পরামর্শ চাইতে। গুরুমা তাকে আদর করে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি অমন মুখ ভার করে আছ কেন?

রাজামশাই আমাকে চারটা হেঁয়ালি জিজ্ঞাসা করেছেন। মাত্র তিন দিন সময় দিয়েছেন জবাবের জন্য।

কি হেঁয়ালি শুনি?

প্রথম হল- পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বলবান আর দ্রতগামী কি জিনিস?

এ আবার একটা হেঁয়ালি? আমাদের ঘোড়াটার মতো দ্রুতগামী আর কিছু নেই। তার গায়ে চাবুক ঠোকাবার মাত্র সে পাঁই পাঁই করে এমন ছুটবে খরগোশকে ও ধরে ফেলবে।

দ্বিতীয় হল- পৃথিবীতে সবচেয়ে মোটা কে?

আমাদের শূয়োরের বাচ্চাটা তার মোটা, কি বলব। দু'বছর বয়স, এখনি সে এমন মোটা হয়েছে যে, উঠে দাঁড়াতে পারে না।

এবার তৃতীয় হেঁয়ালি- পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নরম কোন জিনিস?

ওঃ! এ আর শক্ত কি? - পালকের বিছানার মত নরম আর কিছু নেই।

শেষ হেঁয়ালি হল এই- পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কি?

আমার নাতি ইভানুশকা ই সবচেয়ে প্রিয় জিনিস সন্দেহ নেই ‌

প্রণাম হই গুরুমা। এবার আমি জানলাম কি বলতে হবে রাজামশাইকে।

সেই গরীব ভাই কি করল? সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তার সাত বছরের মেয়েটি। এই মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ ছিল না।


মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, বাবা তুমি কাঁদছ কেন?

হায়, কাঁদব না তো কি করব? রাজামশাই আমাকে চারটি হেঁয়ালি জিজ্ঞাসা করেছেন। আমি কখনোই তার উত্তর দিতে পারব না।

কা হেঁয়ালি বল না?

হেঁয়ালিগুলি হচ্ছে- সবচেয়ে বলবান আর দ্রতগামী কোন জিনিস?

সবচেয়ে মোটা কে?

সবচেয়ে নরম কি?

সবচেয়ে প্রিয় কোন জিনিস?

বাবা, রাজামশায়ের কাছে তুমি বলবে- সবচেয়ে বলবান আর দ্রতগামী হল বাতাস।

সবচেয়ে মোটা পৃথিবীর মাটি; কেন না, যা কিছু বাঁচে এবং বাড়ে, সকলের খাবার সে যোগায়।

সবচেয়ে নরম মানুষের হাত, কারণ তখনি মানুষ শোয়, সে তার হাতখানা রাখে মাথার নিচে।

আর পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হল ঘুম। মেয়ে উত্তর করল।

তিন দিন পরে রাজার কাছে দুই ভাই গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তাদের কথা শুনে রাজামশাই গরীব ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ উত্তরগুলি তুমি নিজে ভেবে বের করেছো?, না আর কেউ বলে দিয়েছে?

রাজামশাই, আমার একটি সাত বছরের মেয়ে আছে। সে ই উত্তরগুলি বলে দিয়েছে।

তোমার মেয়ের যদি এত বুদ্ধি তবে এই রেশমের সুতোটুকু দিয়ে আমার জন্য একখানা ফুল-কাটা তোয়ালে বুনে দেয়।

গরীব ভাই সুতুটুকু নিয়ে অত্যন্ত বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফিরে এল। এসে সে মেয়েকে বলল, বড়ই বিপদের কথা মা। রাজামশাই বলেছেন এই সুতোটুকু দিয়ে তুমি তাকে একখানা তোয়ালে বুনে দেবে সকালের ভিতর।

মেয়ে বলল, ভাবনা নেই বাবা। তারপর সে ঝাঁটা থেকে ডাণ্ডাটা ভেঙে নিয়ে এসে তার বাবার হাতে দিয়ে বলল, তুমি এই ডাণ্ডাটা নিয়ে রাজামশাইকে দাও। তিনি যেন তাঁর কারিগরদের দিয়ে ডাণ্ডা থেকে তাঁত তৈরি করিয়ে দেন।সেই তাঁতে তোয়ালে বুনবো। গরীব ভাই রাজামশাইকে ডাণ্ডাটা দিয়ে দিল, আর মেয়ে যা বলেছিল সে কথা জানাল।

তখন রাজা তাকে পঞ্চাশটা ডিম দিয়ে বললেন, তুমি এই বিষয়গুলো তোমার মেয়েকে দাওগে। সে যেন এ থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে আমাকে কাল সকালে দেয়।

গরীব ভাই আরো বেজার হয়ে বাড়ি ফিরল। এক বিপদ কাটে তো আরেক বিপদ উপস্থিত হয়। সে ডিম থেকে ছানা ফোঁটা বার হুকুম মেয়েকে বলল।



দুঃখ করো না বাবা মেয়েটি জবাব দিল। সে ডিমগুলি সিদ্ধ করে, বিকালে আর রাত্রে খাবার জন্য রেখে দিল। তারপর তার বাবাকে আবার পাঠাল রাজার কাছে এই পরামর্শ দিয়ে- রাজামশাইকে বল, ছানাগুলোর জন্য একদিনের খাওয়ার মতো জেনারেল দানা দরকার। একদিনের ভিতরেই ক্ষেতে চাষ করে, বীজ পুঁতে, জনার কেটে তা কুটে ফেলতে হবে। নইলে ছানারা মোটে একটি দানাও মুখে দেবে না।

সব কথা শুনে রাজামশাই মনে মনে অবাক হলেন, মুখে বললেন, তোমার মেয়ের কত বুদ্ধি এইবারেই বোঝা যাবে। তাকে বলো, কাল সকালে এখানে আসতে- কাপড় পরেও আসবে না, না পরেও আসবে না; হেঁটে আসবে না বা ঘোড়ায় চড়ে আসবে না; আমাকে কোনও উপহার দেবে না অথচ দেবেন।

গরীব ভাই ভাবল- হায় হায় এমন বিদঘুটে কাজ কি আমার মেয়ে করতে পারবে? সবই গেল!

কিন্তু সাত বছরের মেয়েটি বলল- বাবা , কিছু ভেবো না। তুমি শিকারীদের কাছ থেকে আমার জন্য একটা জীবন্ত জংলি খরগোশ আর একটা জীবন্ত তিতির পাগলী কিনে আন।

লোকটি গিয়ে খরগোশ আর তিতির কিনে আনল।

পরদিন ভোরবেলা মেয়েটি নিজের কাপড় ছেড়ে, একটা মাছ ধরবার জাল নিয়ে বেশ করে গায়ে জড়াল। তারপর তিতির হাতে নিয়ে খরগোশের পিঠে চড়ে রওনা হল রাজবাড়ী। বাড়ীর ফটকের কাছে রাজামশাইয়ের সঙ্গে দেখা। মেয়েটি নমস্কার করে বলল, আপনার জন্য এই উপহার এনেছি। বলে পাখীটাকে বাড়িয়ে দিল রাজার দিকে। যেই না রাজা সেটাকে ধরতে যাবেন অমনি- হুস্ করে পাখীটা উড়ে গেল।

বেশ বেশ। মা আমি বলেছিলাম, ঠিক তাই করেছ তুমি। আচ্ছা তোমরা তো গরীব; কেমন করে তোমাদের খাওয়া পরা চলে?

বাবা শুকনো ডাঙ্গায় মাছ ধরেন, নদীর জলে জাল পারেন না। আমি সেই মাছ বাড়ী নিয়ে আসি কাপড়ের ভিতর গুজে আর তারই সরুয়া রেঁধে খাই। খুব ভাল লাগে। আপনারও ভাল লাগবে খেলে। হ্যা।

বোকা মেয়ে শুকনো মাটিতে আবার কে মাছ পায়? তারা তো জলে থাকে।

আর, চালাক রাজামশাই, কোথায় দেখেছেন গাড়ীর বাচ্চা হতে? ঘোড়ীরই বাচ্চা হয়, গাড়ীর নয়‌

তখন রাজামশাই ভারী খুশি হয়ে ঘোড়ার বাচ্চা ফিরিয়ে দিলেন গরীব ভাইকে।

দুই বাংলার রূপকথা

 


রাজকন্যা - দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

রূপনগরে আলোর খেলা - আসরফ সিদ্দিকী

কানকাটা রাজার দেশ - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সাত বছরের মেয়ে - সুখলতা রাও

বাংলা দেশের রূপকথা - মিজানুর রহমান

মায়াকানন - বনফুল

ময়ূরকূট - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

রাজশ্রী - ইন্দিরা দেবী

নির্জন বনপথ - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

লাবু - নরেন্দ্র দেব

শিউলি পরীর দেশে - আবুল কাশেম রহিমউদ্দীন

অঙ্গুরী অপহরণের কাহিনী - স্বপনবুড়ো

অপরূপ রূপকথা - প্রেমেন্দ্র মিত্র

ডালিমকুমার ও ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী - রাধারাণী দেবী

মণিমুকুট - হান্নান আহসান

রাজপুত্র প্রদীপকুমার - বুদ্ধদেব বসু

ফণিমুকুট রাজা - মনোজ বসু

রাজার মন ভাল নেই - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

সোনার পাতার রূপকথা - বেগম জাহানারা খাতুন

উদো রাজার বুদো মন্ত্রী - ধীরেন্দ্রলাল ধর

ডালিমকুমার - সরলাবালা সরকার

যখের জঙ্গলে - আনন্দ বাগচী

চিলনী মা - কার্ত্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত

মাছেরা কোথায় যায় - দিব্যেন্দু পালিত

ময়নামতী - জসীমউদ্দীন

আমার কথাটি ফুরালো - প্রবোধকুমার সান্যাল




Monday, May 8, 2023

গাধার ব্রেন

সিংহ শিয়ালকে বলল - যা আমার জন্য খাবার নিয়ে আয়।

শিয়াল ঘোড়ার কাছে গিয়ে বলল- ভাইজান কেমন আছেন?
ঘোড়া চিন্তা করে দেখলো যে যে শিয়াল খ্যাক খ্যাক করা ছাড়া কোনো কথা বলে না, সে আজ এতো মধুর স্বরে ডাকছে কেন?
নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে।
ঘোড়া শিয়ালের ডাকে সাড়া দিল না। 

শিয়াল এবার ময়ূরের কাছে গিয়ে বলল কেমন আছো। দেখতে খুবই মিষ্টি লাগছে।
ময়ূর বুঝতে পারলো - আরে শিয়ালের মুখে মিষ্টি বচন।  নিশ্চয়ই লক্ষণ ভালো না। 
সেও সাড়া দিল না।

শিয়াল এবার গাধার কাছে গিয়ে বলল - বাহ! তোমাকে খুবই হ্যান্ডসাম মনে হচ্ছে। এরকম হ্যান্ডসাম একটা প্রাণী খেটে খেটে জীবনটা নষ্ট করে দিলো।
তোমাকে আর কষ্ট করতে হবেনা। রাজার বয়স হয়ে গেছে।
তিনি অবসরে যাবেন। আর তোমাকে রাজা বানাবেন। 
চলো আমার সাথে সিংহাসনে চলো।

গাধা খুব খুশি হলো। শিয়ালের সাথে সিংহাসনে আসলো।

সিংহের কাছে আসা মাত্রই সিংহের এক থাবায় গাধা তার কান দুটো হারাল। 

কিন্তু কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচল।

শিয়াল গাধার কাছে এসে  বলে -   এতো বোকা হলে রাজা হবে কিভাবে?

রাজা তোমার মাথায় মুকুট পরাবে। কিন্তু দুপাশে দুটো কান থাকলে কি রাজমুকুট ঠিকমতো মাথায় বসবে?

তাইতো তোমার কান দুটো তুলে নেয়া হয়েছে।
কিছু বুঝনা অবুঝ প্রাণী - এটাকে গ্রুমিং বলে।
চলো চলো আমার সাথে চলো। দেরি হলে অন্য কেউ আবার রাজা হয়ে যাবে!

গাধা আবার সিংহের কাছে আসল। এবার সিংহের আরেক থাবায় তার লেজখানা খসে পড়ে।
কিন্তু এবারও পালিয়ে বাঁচল।

শিয়াল যথারীতি গাধার কাছে এসে বলে- আবারও ভুল করলে।
লেজ থাকলে রাজ সিংহাসনে বসবে কিভাবে।
তাই তোমার লেজটা খসানো হয়েছে।
অবুঝ প্রাণী  দূরদর্শী চিন্তা করতেই পারোনা। 
এটা হলো আলট্রা গ্রুমিং। মানে একেবারে ফাইনাল টাচ।
চলো চলো তাড়াতাড়ি সিংহাসনে চলো।

গাধা আবারও সিংহাসনে আসে। 
এবার আর সে বাঁচতে পারে না। 
সিংহের থাবায় তার  ক্ষত বিক্ষত দেহ খানা মাটিতে পড়ে আছে।

সিংহের দাঁতে মুখে রক্তের দাগ।

শিয়াল সিংহকে বলে - মহারাজ এতো কষ্ট করে আপনি খাবেন।
মাথাটা আমাকে দেন। সুন্দর করে প্লেটে সাজিয়ে দেই।

শিয়াল গাধার ব্রেনটুকু খেয়ে মাথার অবশিষ্ট অংশ সিংহকে  দেয়।
সিংহ  বলে- ব্রেন কোথায়?
শিয়াল বলে- মহারাজ! যে বারবার ধোকা খেয়েও আপনার কাছে এসেছে- আপনি কি মনে করেন তার ব্রেন বলে কিছু আছে?

একটা তুর্কীয় গল্পের ভাবানুবাদ.... 

হঠাৎ করে কেউ যদি বড় আপন হয়ে ওঠে, বুঝতে হবে তার গোপন দূরভিসন্ধি আছে। 

লোভের ফল কখনো মিষ্টি হয়না।
সাদাসিদা হওয়া ভালো। কিন্তু বোকা হওয়া ভালো না।

Saturday, February 8, 2020

রাজার মন ভালো নেই : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

রাজার মন আর কিছুতেই ভালো যাচ্ছে না। রাজা দেখছেন, শুনছেন, খাচ্ছেন, কিন্তু তবু ঘণ্টায় ঘণ্টায় বুক কাঁপিয়ে হুহুংকারে একেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। ‘না হে, মনটা ভালো নেই।’
রাজার মন ভালো করতে সেনাপতি আশপাশের গোটা দশেক রাজ্য জয় করে হেরো রাজাগুলোকে বন্দী করে নিয়ে এলেন। রাজা তাকিয়ে দেখলেন। তার পরই অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন একটা। ‘মনটা বড় খারাপ রে।’
তখন মন্ত্রিমশাই রাজার তীর্থযাত্রা আর দেশভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। লোকলস্কর, পাইক-পেয়াদা নিয়ে রাজা শ দেড়েক তীর্থ আর দেশ-দেশান্তর ঘুরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে সিংহাসনে বসেই বললেন, ‘হায় হায়! মনটা একদম ভালো নেই।’
ওদিকে ভাঁড়ামি করে করে রাজার বিদূষক হেদিয়ে পড়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। রাজনর্তকীর পায়ে বাত। সভাগায়কের গলা বসে গেছে। বাদ্যকরদের হাতে ব্যথা। রসুইকররা ছুটি চাইছে। রাজবৈদ্যকে ধরেছে ভীমরতি। সেনাপতি সন্ন্যাস নিয়েছেন। মন্ত্রিমশাইয়ের মাথায় একটু গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে বলে তাঁর স্ত্রী সন্দেহ করছেন। রাজ-পুরোহিত হোমযজ্ঞের এত ঘি পুড়িয়েছেন যে এখন ঘিয়ের গন্ধ নাকে গেলে তাঁর মূর্ছা হয়। সভাপণ্ডিতেরা রাজার মন খারাপের কারণ নিয়ে দিনরাত গবেষণা করছেন।
একদিন বিকেলে রাজা মুখখানা শুকনো করে রাজবাড়ির বিশাল ফুলবাগিচায় বসে আছেন। হঠাৎ সিংহ গর্জনে বলে উঠলেন, ‘গর্দান চাই!’ মন্ত্রী পাশেই ছিলেন, আপনমনে বিড়বিড় করছিলেন, মাথা খারাপের লক্ষণ। রাজার হুংকারে চমকে উঠে বললেন, ‘কার গর্দান, মহারাজ?’
রাজা লজ্জা পেয়ে বলেন, ‘দাঁড়াও, একটু ভেবে দেখি। হঠাৎ মনে হলো, কার যেন গর্দান নেওয়া দরকার।’
মন্ত্রী বললেন, ‘ভাবুন, মহারাজ, আর একটু কষে ভাবুন। মনে পড়লেই গর্দান এনে হাজির করব।’
বহুকালের মধ্যেও রাজা কিছুই মুখ ফুটে চাননি। হঠাৎ এই গর্দান চাওয়ায় মন্ত্রীর আশা হলো, এবার রাজার মনমতো একটা গর্দান দিলে বোধ হয় মন ভালো হবে। রাজ্যে গর্দান খুবই সহজলভ্য।
পরদিন সকালে রাজসভায় কাজ শেষ হওয়ার পর রাজা মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘না হে, গর্দান নয়। গর্দান চাই না। অন্য কী একটা যেন চেয়েছিলাম, এখন আর মনে পড়ছে না।’
সেই দিনই শেষ রাতে রাজা ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে বললেন, ‘বিছুটি লাগা। শিগ্‌গির বিছুটি লাগা।’ মন্ত্রী রাজার কানে কানে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহারাজ! কাকে বিছুটি লাগাতে হবে তার নামটা একবার বলুন।’
‘বিছুটি!’ বলে রাজা অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন।
পশ্চিমের পাহাড়ের গায়ে সূর্য ঢলে পড়ল। গরুর গাড়িবোঝাই বিছুটি এনে রাজবাড়ির সামনে জমা করা হয়েছে। রাজার সেদিকে মন নেই। রাজা রঙ্গঘরে বসে বয়স্যদের সঙ্গে ঘুঁটি সাজিয়ে দাবা খেলছেন। বয়স্যরা ভয়ে ভয়ে ভুল চাল দিয়ে রাজাকে জিতবার সুবিধে করে দিচ্ছেন। কিন্তু রাজা দিচ্ছেন আরও মারাত্মক ভুল চাল।
খেলতে খেলতে রাজা একবার গড়গড়ার নলে মৃদু একটা টান দিয়ে বললেন, ‘পুঁতে ফেললে কেমন হয়!’
মন্ত্রী কাছেই ছিলেন। বিড়বিড় করা থামিয়ে বিগলিত হয়ে বললেন, ‘খুব ভালো হয়, মহারাজ। শুধু হুকুম করুন।’
রাজা আকাশ থেকে পড়ে বললেন, ‘কিসের ভালো হয়? কিছুতেই ভালো হবে না, মন্ত্রী। মনটা একদম খারাপ।’
সেই রাতেই মন্ত্রী রাজ্যের সবচেয়ে সেরা বাছা বাছা চারজন গুপ্তচরকে ডেকে বললেন, ‘ওরে, তোরা চব্বিশ ঘণ্টা পালা করে রাজামশাইয়ের ওপর নজর রাখবি।’
পরদিনই এক গুপ্তচর এসে খবর দিল, ‘রাজামশাই রাতে অনেকক্ষণ হামা দিয়েছেন ঘরের মেঝেয়।’
আরেকজন বলল, ‘রাজামশাই একা একাই লাল জামা নেব, লাল জামা নেব বলে খুকখুক করে কাঁদছেন।’
আরেকজন এসে খবর দিল, ‘রাজামশাই এক দাসীর বাচ্চাছেলের হাত থেকে একটা মণ্ডা কেড়ে নিজেই খেয়ে ফেললেন এই মাত্র।’
মন্ত্রী বললেন, ‘ঠিক আছে, নজর রেখে যা।’
পরদিনই প্রথম গুপ্তচর এসে বলল, “আজ্ঞে, রাতে শোয়ার ঘরের জানালা দিয়ে যেই উঁকি দিয়েছি, দেখি রাজামশাই আমার দিকেই চেয়ে আছেন। দেখে বললেন, ‘নজর রাখছিস? রাখ।’ বলে চোখ বুজে শুয়ে পড়লেন।”
দ্বিতীয়জন বলল, “আজ্ঞে, আমি ছিলাম রাজার খাটের তলায়। মাঝরাতে রাজামশাই আমাকে বললেন, ‘কানে কেন্নো ঢুকবে, বেরিয়ে আয়’।” তৃতীয়জন কান চুলকে বলল, “আজ্ঞে, আমি রাজার কুঞ্জবনে রাজার ভুঁইমালী সেজে গাছ ছাঁটছিলাম। রাজা ডেকে খুব আদরের গলায় বললেন, ‘ওরে, ভালো গুপ্তচর হতে গেলে সব কাজ শিখতে হয়। ওভাবে কেউ গাছ ছাঁটে নাকি? আয় তোকে শিখিয়ে দিই।’ বলে রাজা নিজেই গাছ ছেঁটে দেখিয়ে দিলেন।”
কিন্তু সবচেয়ে তুখোড় যে গুপ্তচর সেই রাখহরি তখনো এসে পৌঁছায়নি।
সকালবেলা রাজার শোয়ার ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল রাখহরি। রাজা বেরোতেই প্রণাম করে বলল, ‘মহারাজ, আমি গুপ্তচর রাখহরি আপনার ওপর নজর রাখছি।’
রাজা ্নিত হেসে হাই তুলে বললেন, ‘বেশ বেশ, মন দিয়ে কাজ করো।’
তারপর রাজা যেখানে যান পেছনে রাখহরি ফিঙের মতো লেগে থাকে।
দুপুর পর্যন্ত বেশ কাটল। দুপুরে খাওয়ার পর পান চিবোতে চিবোতে রাজা হঠাৎ বললেন, ‘চিমটি দে। রাম চিমটি দে।’
সঙ্গে সঙ্গে রাখহরি পেটে এক বিশাল চিমটি বসিয়ে দিল। রাজা আঁক করে উঠে বললেন, ‘করিস কী, করিস কী?’
রাখহরি বলল, ‘বললেন যে।’
পেটে হাত বোলাতে বোলাতে রাজা কিন্তু হাসলেন।
বিকেলে রাজা বাগানে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ল্যাঙ মেরে ফেলে দে।’ বলতে না বলতেই রাখহরি ল্যাঙ মারল। রাজা চিতপটাং হয়ে পড়ে চোখ পিটপিট করতে লাগলেন! রাখহরি রাজার গায়ের ধুলোটুলো ঝেড়ে দাঁড় করিয়ে রাজার পায়ের ধুলো নিল। রাজা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘হুঁ।’
রাত পর্যন্ত রাজা আর কোনো ঝামেলা করলেন না। রাখহরি রাজার সামনেই একটা আলমারির ধারে লুকিয়ে রইল। রাজা একটু হাসলেন। আপত্তি করলেন না। কিছুক্ষণ পরেই রাজা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ঠান্ডা জলে চান করব।’ রাখহরি বিদ্যুৎগতিতে রাজার ঘরের কলসের সবটুকু জল রাজার গায়ে ঢেলে দিল।
রাজা চমকে হেঁচে-কেশে উঠে বসলেন। কিন্তু খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হলো না। রাখহরির দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, শুগে যা।’
রাখহরি না শুয়ে পাহারায় রইল।
সকালে উঠে রাজা হাই তুলে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘দে, বুকে ছোরা বসিয়ে দে।’···চকিতে রাখহরি কোমরের ছোরাখানা খুলে রাজার বুকে ধরল। ভ্যাবাচেকা খেয়ে রাজা বললেন, ‘থাক, থাক, তোর কথা আমার মনে ছিল না।’
রাখহরি ছোরাটা খাপে ভরতেই রাজা হোঃ হোঃ করে হাসতে লাগলেন। সে এমন হাসি যে রাজবাড়ির সব লোক ছুটে এল। রাজা হাসতে হাসতে দুহাতে পেট চেপে ধরে বললেন, ‘ওরে, আমার যে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে! ভীষণ হাসি পাচ্ছে!’
খবর পেয়ে মন্ত্রীও এসেছেন। রাজার বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘যাক বাবা! মন খারাপটা গেছে তাহলে।’
তার পর থেকে রাজার মন খারাপ কেটে গেলো। কিন্তু নতুন একটা সমস্যা দেখা গেল আবার। রাজা সব সময় কেবল ফিকফিক করে হেসে ফেলছেন। যুদ্ধে হার হয়েছে? ফিক-ফিক। অমুক মারা গেছে? ফিক-ফিক। রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে? ফিক-ফিক।
রাজার হাসি বন্ধ করার জন্য মন্ত্রীকে এখন আবার দ্বিগুণ ভাবতে হচ্ছে।
[সংক্ষেপিত]
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ ভারতীয় লেখক। ১৯৩৫ সালে তিনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন।

Friday, October 20, 2017

বাংলাদেশের ইতিহাসঃ আলেকজান্ডার থেকে শশাঙ্ক থেকে বঙ্গবন্ধু

প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ বাংলায় পাওয়া গেছে।
ইন্দো-আর্যদের আসার পর অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্য গঠিত হয় খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকে। এই রাজ্যগুলি বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছিল। অঙ্গ বঙ্গ এবং মগধ রাজ্যের বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় অথর্ববেদে প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল। মগধ ছিল একটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য রাজ্য। মগধের কথা রামায়ণ এবং মহাভারতে পাওয়া যায়। বুদ্ধের সময়ে এটি ছিল ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে একটি। মগধের ক্ষমতা বাড়ে বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এবং তার ছেলে অজাতশত্রুর (রাজত্বকাল ৪৯১-৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) আমলে। বিহার এবং বাংলার অধিকাংশ জায়গাই মগধের ভিতরে ছিল ।
৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনী মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানার দিকে অগ্রসর হয়। এই সেনাবাহিনী ক্লান্ত ছিল এবং গঙ্গা নদীর কাছাকাছি বিশাল ভারতীয় বাহিনীর মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ে যায়। এই বাহিনী বিয়াসের কাছে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং আরও পূর্বদিকে যেতে অস্বীকার করে। আলেকজান্ডার তখন তার সহকারী কইনাস (Coenus) এর সাথে দেখা করার পরে ঠিক করেন ফিরে যাওয়াই ভাল।

১. মৌর্য সাম্রাজ্য

মৌর্য সাম্রাজ্য (রাজত্বকাল ৩২১-১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মগধেই গড়ে উঠেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। এই সাম্রাজ্য অশোকের রাজত্বকালে দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান অবধি বিস্তার লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্য মগধেই গড়ে ওঠে যা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাংশে এবং পারস্য এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশে বিস্তার লাভ করেছিল। চন্দ্রগুপ্ত ---> বিন্দুসার ---> অশোক।

২. গৌড় রাজ্য

বাংলা অঞ্চলের প্রথম স্বাধীন রাজা ছিলেন রাজা শশাঙ্ক যিনি ৬০৩ থেকে ৬৩৭ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু বাংলাকে শাষন করেছেন। তার সাম্রাজ্যের বিসতৃতির সঠিক ধারণা পাওয়া না গেলেও প্রাচীন বাংলা বলতে আমরা বুঝি পশ্চিম বঙ্গ যা আজকের কালকাতা আর আসাম, ত্রিপুরার কিছু অঞ্চল, বিহার, উডিস্যা ও পূর্ববাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ যা তখন গৌড় বলে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাষনামলে বাংলাভাষী অঞ্চল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি নামে পরিচিত ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন তাঁর পুত্র মানব, যিনি ৮ মাস পর্যন্ত গৌড়ের শাসনকার্য চালান। তার কিছুকাল পরই গৌড়, সম্রাট হর্ষবর্ধণ এবং কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মণ কর্তৃক দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শশাঙ্কের মৃত্যুর সাথে সাথে তার রাজবংশের পতন ঘটে এবং বাংলায় শুরু হয় এক অরাজক পরিবেশ যা ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় নামে পরিচিত।

৩. মাৎস্যন্যায় বা বাংলার অরাজক অবস্থা

গৌড় শাষক শশাংকের মৃত্যুর পর বা তার রাজ বংশের পতনের পর বাংলায় আর কোন কেন্দ্রেীয় শাষক ছিলেন না। সমগ্র বঙ্গে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছোট ছোট রাজ্যের সৃষ্টি হল যা শাষন করত কিছু অত্যাচারি দুর্বল শাষক। বঙ্গের জনগনের উপর নেমে এসেছিল সীমাহীন দুঃখ দুর্দশা। জোর যার মুল্লুক তার এই নীতিতে দেশ চলছিল। যে বা যারা জোর খাটাতে পারত সেই ছিল সেখানকার অধিপতি। অভিভাবকহীন সন্তান যেমন বেপরোয়া চলে, যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায় ঠিক তেমনি বাংলার জনগনও অভিবাবকহীন হয়ে যে যার মত করে চলতে লাগল যা ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় বলে পরিচিত। মাৎস্যন্যায়ের স্থায়ীত্বকাল ছিল ১৫০ বছর বা ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

৪. পাল রাজবংশ

মাৎস্যন্যায় সময়ের ভয়বহতা উপলব্ধি করে বাংলার জনগন গোপাল নামক এক সামন্ত রাজাকে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাজা হিসেবে গ্রহণ করেন। সেই থেকে শুরু হয় পাল রাজবংশের। গোপালই পাল রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। গোপাল রাজ বংশের শক্তিশালি দুই রাজা ছিলেন যথক্রমে ধর্মপাল (রাজত্বকাল ৭৮১-৮২১ খ্রীষ্টাব্দ) এবং দেবপাল (রাজত্বকাল ৮২১-৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ)। পাল বংশের স্থায়ীত্বকাল ছিল প্রায় ৪০০ বছর।
  1. প্রথম গোপাল (৭৫৬-৭৮১)
  2. ধর্মপাল (৭৮১-৮২১)
  3. দেবপাল (৮২১-৮৬১)
  4. প্রথম বিগ্রহপাল, মহেন্দ্রপাল ও প্রথম শূরপাল (৮৬১-৮৬৬)
  5. নারায়নপাল (৮৬৬-৯২০)
  6. রাজ্যপাল (৯২০-৯৫২)
  7. দ্বিতীয় গোপাল (৯৫২-৯৬৯)
  8. দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬৯-৯৯৫)
  9. প্রথম মহীপাল (৯৯৫-১০৪৩)
  10. নয়াপাল (১০৪৩-১০৫৮)
  11. তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৮-১০৭৫)
  12. দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০)
  13. দ্বিতীয় শূরপাল (১০৭৫-১০৭৭)
  14. রামপাল (১০৮২-১১২৪)
  15. কুমারপাল (১১২৪-১১২৯)
  16. তৃতীয় গোপাল (১১২৯-১১৪৩)
  17. মদনপাল (১১৪৩-১১৬২)

৫.  সেন রাজবংশ:

পাল রাজবংশের রাজা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে বারেন্দ্র সামন্তচক্রেরবিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করেন এবং অবশেষে বাংলার পাল রাজবংশের রাজা মদনপালের রাজত্বকালে স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশ ঘটান। বাংলায় সেন শাসনের বিশেষ তাৎপর্য এই যে, সেনগণই সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলার ওপর তাদের নিরঙ্কুশ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বাংলার সেন বংশীয় রাজাদের মধ্যে বিজয় সেন, বল্লাল সেন, ও লক্ষ্মণ সেন বিশিষ্ট স্থান অধিকার করছেন। সেন রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন হলেও মূল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন সামন্ত সেন ও হেমন্ত সেন। পরে হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেনই সেন রাজবংশের বিস্তিৃতি ঘটান। অবশেষে বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন রাজা ছিলেন সেন বংশেরেই লক্ষন সেন। এর পরই বাংলায় শুরু হয় মুসলিম শাষন।
  1. হেমন্ত সেন (১০৯৭)
  2. বিজয় সেন (১০৯৭-১১৬০)
  3. বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮)
  4. লক্ষ্মন সেন (১১৭৮-১২০৬)
  5. বিশ্বরূপ সেন (১২০৬-১২২০)
  6. কেশব সেন (১২২০-১২৫০)

৬. মুসলিম শাসন:

ভারতীয় উপমহাদেশে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের শুরু হলেও বাংলায় মুসলিম শাসন আসে ১২০৪ সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির হাত ধরে। তিনিই প্রথম ১৭ মতান্তরে ১৮ জন ঘোড় সওয়ারী সৈন্য নিয়ে তখনকার বাংলার রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করে রাজা লক্ষণ সেনকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে ও এ দেশে মুসলিম শাসনের পথ সুগম করেন।  প্রায় ৬০০ বছরের কাছাকাছি সময় অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে মুসলিম শাষন অব্যাহত ছিল।

6.1      ইলিয়াস শাহী বংশ (প্রথম পর্ব)

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) (১৩৪২ থেকে পশ্চিম বাংলার লখনৌতি রাজ্যের সুলতান এবং ১৩৫২ থেকে পুরো বাংলায়)
  1. প্রথম সিকান্দর শাহ (১৩৫৮-১৩৯০)
  2. গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১১)
  3. সাইফুদ্দীন হামজা শাহ (১৪১১-১৪১৩)
  4. মুহাম্মদ শাহ (১৪১৩)

6.2      বায়াজিদ বংশ

  1. শিহাবুদ্দিন বায়াজিদ শাহ (১৪১৩-১৪১৪)
  2. প্রথম আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৪১৪-১৪১৫)

6.3      গণেশ বংশ

  1. রাজা গণেশ (১৪১৪-১৪১৫ এবং ১৪১৬-১৪১৮)
  2. জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৫-১৪১৬ এবং ১৪১৮-১৪৩৩)
  3. শামসুদ্দীন আহমদ শাহ (১৪৩৩-১৪৩৫)

6.4      ইলিয়াস শাহী বংশ (দ্বিতীয় পর্ব)

  1. প্রথম নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-১৪৫৯)
  2. রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪)
  3. শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১)
  4. দ্বিতীয় সিকান্দর শাহ (১৪৮১)
  5. জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭)

6.5      হাবসি বংশ

  1. বারবক শাহ (১৪৮৭)
  2. সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-১৪৯০)
  3. দ্বিতীয় নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৯০)
  4. শামসুদ্দীন মুজাফ্ফর শাহ (১৪৯০-১৪৯৩)

6.6      হুসেন বংশ

  1. আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)
  2. নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩২)
  3. দ্বিতীয় আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৫৩২-১৫৩৩)
  4. গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮)

6.7      শূর বংশ

  1. শের শাহ শূরি (১৫৪০-১৫৪৫)
  2. ইসলাম শাহ শূরি (১৫৪৫-১৫৫৩)
  3. ফিরোজ শাহ শূরি (১৫৫৩)
  4. আদিল শাহ শূরি (১৫৫৩-১৫৫৭)- তাঁর শাসনকালে ১৫৫৫ সালে বাংলার শাসক মুহাম্মদ খান শূরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং 'শামসুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ' উপাধী ধারণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন।
  5. শামসুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ (১৫৫৫)
  6. প্রথম গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ (১৫৫৫-১৫৬০)
  7. গিয়াসুদ্দীন জালাল শাহ (১৫৬০-১৫৬২)
  8. দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ (১৫৬২-১৫৬৩)

6.8      কররানি বংশ

  1. তাজ খান কররানি (১৫৬৩)
  2. সুলায়মান কররানি (১৫৬৩-১৫৭২)
  3. বায়াজিদ কররানি (১৫৭২-১৫৭৩)
  4. দাউদ খান কররানি (১৫৭৩-১৫৭৬)

6.9      মুঘল আমল(১৫২৬-১৮৫৭)

  1. মুর্শিদকুলি জাফর খান ১৭০৩-১৭২৭
  2. সুজা উদ্দিন ১৭২৭-১৭৩৯
  3. সফররাজ খান ১৭৩৯-১৭৪০
  4. আলিবর্দী খান ১৭৪০-১৭৫৬
  5. সিরাজদ্দৌলা ১৭৫৬-১৭৫৭

৭. ইংরেজ শাসন:

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশির আম বাগানে ভগিরতি নদীর তীরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দোলার মৃত্যুর মাধ্যমে এ দেশে ইংরেজ শাসনের উন্মেষ হলো। মীর জাফরের মীর জাফরীর কারণে বাংলা তথা পুরো ভারতবর্ষ হারালো তাঁর স্বাধীনতা।
  1. মীরজাফর ১৭৫৭-১৭৬০
  2. মীরকাসিম ১৭৬০-১৭৬৩
  3. মীরজাফর (দ্বিতীয় বার) ১৭৬৩-১৭৬৫
  4. নাজম উদ দৌলা ১৭৬৫-১৭৬৬
  5. সইফ উদ দৌলা ১৭৬৬-১৭৭০

ব্রিটিশ শাসনের সময়ে দুটি মারাত্মক দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর বহুমানুষের জীবনহানি ঘটিয়েছিল। প্রথম দুর্ভিক্ষটি ঘটেছিল ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে এবং দ্বিতীয়টি ঘটেছিল ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে। ১৭৭০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে বাংলার দুর্ভিক্ষটি ছিল ইতিহাসের সব থেকে বড় দুর্ভিক্ষগুলির মধ্যে একটি। বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল ১৭৭০ এবং তার পরবর্তী বছরগুলিতে।
অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে, ১৯ শতক জুড়ে এবং ২০ শতকের প্রথমার্ধে সমাজ সংস্কার আন্দোলনই বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত। রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২ ১৮৩৩) হাত ধরে ১৯ শতকে এ নবজাগরণের সূচনা। ২০ এর শতকের মধ্যমাংশে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে অবসান ঘটে এ নবজাগরণের। অসংখ্য সাহিত্যিক , বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও দেশপ্রেমিকের হাত ধরে বাংলার নবজাগরণ বাংলাকে উত্তরণ করে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে।
১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শাসনের অবসান ঘটায় এবং বাংলা সরাসরি ভাবে ব্রিটিশ রাজবংশের শাসনাধীনে আসে ।

৮. দেশ বিভাজন

দীর্ঘ ১৯০ বছর (১৭৫৭) ব্রিটিশদের গোলামীর পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজন হয়ে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্থান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। ক্লিপটনের মনগড়া সীমান্ত নির্ণয়ে তৈরি হলো ভারত ও পাকিস্থানের বির্তকিত ভূখন্ড। হিন্দু-মুসলিম চলমান দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলেই এই দেশ বিভাজন।

৯. স্বাধীনতার শুরু

  1. ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন।
  2. ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও না পাওয়া।
  3. ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল লজারি করে।
  4. ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন।
  5. ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারের মুখে টিকতে না পেরে শেষাবধি ২৫ মার্চ পাকিস্তানের লৌহ মানবপ্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সারা দেশে নতুন করে জারি হয় সামরিক শাসন
  6. ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসন হতে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্যে থাকবে দু'জন প্রধানমন্ত্রী। "এক ইউনিট কাঠামো" নিয়ে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এরূপ অভিনব প্রস্তাব নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ভুট্টো মুজিবের ৬-দফা দাবি মেনে নিতেও অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন।
  7. ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।
  8. ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দিন আহমদের উপর। বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
  9. ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়। তারপরও সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। যদিও এই হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা, বাঙালি হত্যা পুরো দেশজুড়ে চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ্য। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল - জগন্নাথ হল - পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছে, তবে হামিদুর রহমান কমিশনের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করেছিলো। জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হলগুলোতে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ভিডিওটেপে ধারণ করেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনলজি (বর্তমান বুয়েট) এর প্রফেসর নূরুল উলা।
  10. ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়।
  11. ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজগুলো মাইন দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।
  12. ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে "ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।" পাঁচটা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের উদ্দেশ্যে এবং সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে প্রেরিত হয় ভারতীয় ভূখণ্ডের গভীরে আগ্রায় আঘাত করার উদ্দেশ্যে। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আক্রমণে। মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেতার বক্তৃতায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। এর আগেই বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে পরাস্ত করে ঢাকার সকল সামরিক বিমান ঘাঁটির রানওয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন উত্তরে চীন ও দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁদের জন্য সহায়তা আসবে, কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে নি।
  13. ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।



Wednesday, September 6, 2017

জোলা আর সাত ভুত

জোলা আর সাত ভুত

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

এক জোলা ছিল সে পিঠে খেতে বড় ভালবাসত।
একদিন সে তার মাকে বলল, ‘মা, আমার বড্ড পিঠে খেতে ইচ্ছে করছে,আমাকে পিঠে করে দাও।’
সেইদিন তার মা তাকে লাল-লাল, গোল-গোল, চ্যাপটা-চ্যাপটা সাতখানি চমৎকার পিঠে করে দিল। জোলা সেই পিঠে পেয়ে ভারি খুশি হয়ে নাচতে লাগল আর বলতে লাগল,
‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’
জোলার মা বলল, ‘খালি নাচবিই যদি, তবে খাবি কখন?’
জোলা বলল, ‘খাব কি এখানে? সবাই যেখানে দেখতে পাবে, সেখানে গিয়ে খাব।’ ব’লে জোলা পিঠেগুলি নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি থেকে গেল, বলতে লাগল,
‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’
নাচতে নাচতে জোলা একেবারে সেই বটগাছতলায় চলে এল, যেখানে হাট হয়। সেই গাছের তলায় এসে সে খালি নাচছে আর বলছে,
‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’
এখন হয়েছে কি-সেই গাছে সাতটা ভূত থাকত। জোলা ‘সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব’ বলছে, আর তা শুনে তাদের ত বড্ড ভয় লেগেছে। তারা সাতজনে গুটিগুটি হয়ে কাঁপছে, আর বলছে,‘ওরে সর্বনাশ হয়েছে! ঐ দেখ, কেত্থেকে এক বিটকেল ব্যাটা এসেছে, আর বলছে আমাদের সাতজনকেই চিবিয়ে খাবে! এখন কি করি বল্‌ ত! অনেক ভেবে তারা একটা হাঁড়ি নিয়ে জোলার কাছে এল। এসে জোড়হাত করে তাকে বলল, ‘দোহাই কর্তা! আমাদের চিবিয়ে খাবেন না। আপনাকে এই হাঁড়িটি দিচ্ছি, এইটি নিয়ে আমাদের ছেড়ে দিন।’
সাতটা মিশমিশে কালো তালগাছপানা ভূত, তাদের কুলোর মত কান, মুলোর মত দাঁত, চুলোর মত চোখ-তারা জোলার সামনে এসে কাঁইমাই করে কথা বলছে দেখেই ত সে এমনি চমকে গেল যে, সেখান থেকে ছুটে পালাবার কথা তার মনেই এল না। সে বলল, ‘হাঁড়ি নিয়ে আমি কি করব?’
ভূতেরা বলল, ‘আজ্ঞে, আপনার যখন যা খেতে ইচ্ছে হবে, তাই এই হাঁড়ির ভিতর পাবেন।’
জোলা বলল, ‘বটে! আচ্ছা পায়েস খাব।’
বলতে বলতেই সেই হাঁড়ির ভিতর থেকে চমৎকার পায়েসের গন্ধ বেরুতে লাগল। তেমন পায়েস জোল কখনো খায় নি, তার মাও খায় নি, তার বাপও খায় নি। কাজেই জোলা যার-পর-নাই খুশি হয়ে হাঁড়ি নিয়ে সেখান থেকে চলে এল, আর ভূতেরা ভাবল, ‘বাবা! বড্ড বেঁচে গিয়েছি।’
তখন বেলা অনেক হয়েছে, আর জোলার বাড়ি সেখান থেকে ঢের দূরে। তাই জোলা ভাবল, ‘এখন এই রোদে কি করে বাড়ি যাব? বন্ধুর বাড়ি কাছে আছে, এবেলা সেইখানে যাই। তারপর বিকেলে বাড়ি যাব এখন।’
বলে সে তার বন্ধুর বাড়ি এসেছে। সে হতভাগা কিন্তু ছিল দুষ্টু। সে জোলার হাঁড়িটি দেখে জিজ্ঞাসা করল, হাঁড়ি কোত্থেকে আনলি রে।’
জোলা বলল, ‘বন্ধু, এ যে-সে হাঁড়ি নয়, এর ভারি গুণ।’
বন্ধু বলল ‘বটে? আচ্ছা দেখি ত কেমন গুণ।’
জোলা বলল, ‘তুমি যা খেতে চাও, তাই আমি এর ভিতর থেকে বার করতে পারি।’
বন্ধু বলল, ‘আমি রাবড়ি, সন্দেশ, রসগোল্লা, সরভাজা, মালপুয়া, পাস্তুয়া, কাঁচাগোল্লা, ক্ষীরমোহন, গজা, মতিচুর জিলিপি, অমৃতি, চমচম এইসব খাব।’
জোলার বন্ধু যা বলছে, জোলা হাঁড়ি ভিতর হাত দিয়ে তাই বার করে আনছে। এ-সব দেখে তার বন্ধু ভাল যে, এ জিনিসটি চুরি না করলে হচ্ছে না।
তখন জোলাকে কতই আদর করতে লাগল! পাখা এনে তাকে হাওয়া করল, গামছা দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিল, আর বলল, ‘আহা ভাই, তোমার কি কষ্টই হয়েছে! গা দিয়ে ঘাম বয়ে পড়েছে! একটু ঘুমোবে ভাই? বিছানা করে দেব?’
সত্যি সত্যি জোলার তখন ঘুব পেয়েছিল। কাজেই সে বলল, ‘আচ্ছা বিছানা করে দাও।’ তখন তার বন্ধু বিছানা করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে, তার হাঁড়িটি বদ্‌লে তার জায়গায় ঠিক তেমনি ধরনের আর একটা হাঁড়ি রেখে দিল। জোলা তার কিছুই জানে না, সে বিকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ি চলে এসেছে আর তার মাকে বলছে, ‘দেখো মা, কি চমৎকার একটা হাঁড়ি এনেছি। তুমি কি খাবে, মা? সন্দেশ খাবে? পিঠে খাবে? দেখো আমি এর ভিতর থেকে সে-সব বার করে দিচ্ছি।’
কিন্তু এ ত আর সে হাঁড়ি নয়, এর ভিতর থেকে সে-সব জিনিস বেরুবে কেন? মাঝখান থেকে জোলা বোকা ব’নে গেল, তার মা তাকে বকতে লাগল।
তখন ত জোলার বড্ড রাগ হয়েছে, আর সে ভাবছে, ‘সেই ভূত ব্যাটাদেরই এ কাজ।’ তার বন্ধু যে তাকে ঠকিয়েছে, এ কথা তার মনেই হল না।
কাজেই পরদিন সে আবার সেই বটগাছতলায় গিয়ে বলতে লাগল,
‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’
তা শুনে আবার ভূতগুলো কাঁপতে কাঁপতে একটা ছাগল নিয়ে এসে তাকে হাত জোড় করে বলল, ‘মশাই গো! আপনার পায়ে পড়ি, এই ছাগলটা নিয়ে যান। আমাদের ধরে খাবেন না।’
জোলা বলল, ‘ছাগলের কি গুণ?’
ভূতরা বলল, ‘ওকে সুড়সুড়ি দিয়ে ও হাসে, আর ও মুখ দিয়ে খালি মোহর পড়ে।’
অমনি জোলা ছাগলের গায়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। আর ছাগলটাও ‘হিহি হিহি’ করে হাসতে লাগল, আর মুখ দিয়ে ঝর ঝর করে খালি মোহর পড়তে লাগল। তা দেখে জোলার মুখে ত আর হাসি ধরে না। সে ছাগাল নিয়ে ভাবল যে, এ জিনিস বন্ধুকে না দেখালেই নায়।
সেদিন তার বন্ধু তাকে আরো ভাল বিছানা করে দিয়ে দুহাতে দই পাখা দিয়ে হাওয়া করল। জোলার ঘুমও হল তেমনি। সেদিন আর সন্ধ্যার আগে তার ঘুম ভাঙল না। তার বন্ধু ত এর মধ্যে কখন তার ছাগল চুরি করে তার জায়গয় আর-একটা ছাগল রেখে দিয়েছে।
সন্ধ্যার পর জোলা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে তার বন্ধুর সেই ছাগলটা নিয়ে বাড়ি এল। এসে দেখল, যে তার মা তার দেরি দেখে ভারি চটে আছে। তা দেখে সে বলল, ‘রাগ আর করতে হবে না, মা। আমার ছাগলের গুণ দেখলে খুমি হয়ে নাচবে!’ বলেই সে ছাগলের বগলে আঙুল দিয়ে বলল, ‘কাতু কুতু কুতু কুতু কুতু!!!’
ছাগল কিন্ত তাতে হাসলো না, তার মুখ দিযে মোহরও বেরুল না। জোলা আবার তাকে সুড়সুড়ি দিলে বলল, ‘কাতু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু!!’
তখন সেই ছাগল রেগে গিয়ে শিং বাগিয়ে তার নাকে অমনি বিষম গুঁতো মারল যে, সে চিত হয়ে পড়ে চেঁচাতে লাগল। আর তার নাক দিয়ে রক্তও পড়ল প্রায় আধ সের তিন পোয়া। তার উপর আবার তার মা তাকে এমনি বকুনি দিল যে, তেমন বকুনি সে আর খায় নি।
তাতে জোলার রাগ যে হল, সে আর কি বলব! সে আবার সেই বটগাছতলায় গিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’
‘বেটারা আমাকে দুবার ফাঁকি দিয়েছিস, ছাগল দিয়ে আমার নাক থেঁতলা করে দিয়েছিস-আজ আর তোদের ছাড়ছি নে!’
ভূতেরা তাতে ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, সে কি মশাই, আমার কি করে আপনাকে ফাঁকি দিলুম, আর ছাগল দিয়েই বা কিরে আপনার নাক থেঁতলা করলুম?’
জোলা তার নাক দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখ না, গুঁতো মেরে সে আমার কি দশা করেছ। তোদের সব কটাকে চিবিয়ে খাব!’
ভূতেরা বলল, ‘সে কখনো আমাদের ছাগল নয়। আপনি কি এখান থেকে সোজাসুজি বাড়ি গিয়েছিলেন?’
জোলা বলল, ‘না, আগে বন্ধুর ওখানে গিয়েছিলুম।সেখানে খানিক ঘুমিয়ে তারপর বাড়ি গিয়েছিলুম।’
ভূতেরা বলল, ‘তবেই ত হছেয়ে! আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, সেই সময় আপনার বন্ধু আপনার ছাগল চুরি করেছে।’ একথা শুনেই জোলা সব বুঝতে পারল। সে বলল, ‘ঠিক ঠিক। সে বেটাই আমার হাঁড়ি চুরি করেছে। এখন কি হবে?’
ভূতেরা তাকে একগাছি লাঠি দিয়ে বলল, ‘এই লাঠি আপনার হাঁড়িও এনে দেবে, ছাগলও এনে দেবে। ওকে শুধু একটিবার আপনার বন্ধুর কাছে নিয়ে বলবেন, ‘লাঠি লাগ। ত!’ তা হলে দেখবেন, কি মজা হবে! লাখ লোক ছুটে এলেও এ লাঠির সঙ্গে পারবে না, লাঠি তাদের সকলকে পিটে ঠিক করে দেবে।’
জোলা তখন সেই লাঠিটি বগলে করে তার বন্ধুর গিয়ে বলল, ‘বন্ধু, একটা মজা দেখবে?’
বন্ধু ত ভেবেছে, না জানি কি মজা হবে। তারপর যখন জোলা বলল, ‘লাঠি, লাগ্‌ ত!’ তখন সে এমনি মজা দেখল, যেমন তার জন্মে আর কখনো দেখে নি। লাঠি তাকে পিটে পিটে তার মাথা থেকে পা অবধি চামড়া তুলে ফেলল। সে ছুটে পালাল, লাঠি তার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তাকে পিটতে পিটতে ফিরিয়ে নিয়ে এল। তখন সে কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে বলল, ‘তার পায়ে পড়ি ভাই, তোর হাড়ি নে, তোর ছাগল নে আমাকে ছেড়ে দে।’
জোলা বলল, ‘আগে ছাগল আর হাঁড়ি আন্‌, তবে তোকে ছাড়ব।’
কাজেই বন্ধুমশাই আর করেন? সেই পিটুনি খেতে খেতেই হাঁড়ি আর ছাগল এনে হাজির করলেন। জোলা হাঁড়ি হাতে নিয়ে বলল, ‘সন্দেশ আসুক ত“!’অমনি হাঁড়ি সন্দেশে ভরে গেল। ছাগলকে সুড়সুড়ি দিতে না দিতেই সে হো হো করে হেসে ফেলল, আর তার মুখ দিয়ে চারশোটা মোহর বেরিয়ে পড়ল। তখন সে তার লাঠি, হাঁড়ি আর ছাগল নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
এখন আর জোলা গরিব নেই, সে বড়মানষ হয়ে গেছে। তার বাড়ি, তার গাড়ি হাতি-ঘোড়া-খাওয়া-পরা, চাল-চলন, লোকজন সব রাজার মতন। দেশের রাজা তাকে যার পর নাই খাতির করেন, তাকে জিজ্ঞাসা না করে কোন ভারি কাজে হাত দেন না।
এর মধ্যে একদিন হয়েছে কি, আর কোন দেশের এক রাজা হাজার লোকজন নিয়ে এসে সেই দেশ লুটতে লাগল। রাজার সিপাইদের মেরে খোঁড়া করে দিয়েছে, এখন রাজার বাড়ি লুটে কখন তাঁকে ধরে নিয়ে যাবে, তার ঠিক নেই।
রাজামশাই তাড়াতাড়ি জোলাকে ডাকিয়ে বললেন, ভাই, এখন কি করি বল্‌ ত? বেঁধেই ও নেবে দেখছি।’
জোলা ললর, ‘আপনার কোন ভয় নেই। আপনি চুপ করে ঘরে বসে থাকুন, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।’
বলেই সে তার লাঠিটি বগলে করে রাজার সিংহদরজার বাইরে গিয়ে চুপ ক’রে বসে রইল। বিদেশী রাজা লুটতে লুটতে সেই দিকেই আসছে, তার সিপাই আর হাতি ঘোড়ার গোলমালে কানে তালা লাগছে, ধুলোয় আকাশ ছেয়ে গিয়েছে। জোলা খালি চেয়ে দেখছে, কিছু বলে না।
বিদেশী রাজা পাহাড়ের মতন এক হাতি চড়ে সকলের আগে আগে আসছে, আর ভাবছে, সব লুটে নেবে। আর, জোলা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে, আর একটু কাছে এলেই হয়।
তারপর তারা যেই কাছে এসেছে, অমনি জোলা তার লাঠিকে বলল, ‘লাঠি, লাগ্‌ ত।’ আর যাবে কোথায়? তখনি এক লাঠি লাখ লাখ হয়ে রাজা আর তার হাতি- ঘোড়া সকলের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল্‌ আর পিটুনি যে কেমন দিল, সে যারা সে পিটুনি খেয়েছিল তারাই বলতে পারে।
পিটুনি খেয়ে রাজা চেঁচাতে চেঁচাতে বলল, ‘আর না বাবা, আমাদের ঘাট হয়েছে, এখন ছেড়ে দাও, আমরা দেশে চলে যাই।’
জোলা কিছু বলে না, খালি চুপ করে চেয়ে দেখছে আর একটু একটু হাসছে।
শেষে রাজা বলল, ‘তোমাদের যা লুটেছি, সব ফিরিয়ে দিচ্ছি, আমার রাজ্য দিচ্ছি, দোহই বাবা, ছেড়ে দাও।’
তখন জোলা গিয়ে তার রাজাকে বলল, ‘রাজামশাই, সব ফিরিয়ে দেবে বলছে, আর তাদের রাজ্যও আপনাকে দেবে বলছে, আর বলছে, দোহাই বাবা, ছেড়ে দাও। এখন কি হুকুম হয়?’
রাজামহাশয়ের কথায জোলা তার লাঠি থামিযে দিলে। তারপর বিদেশী রাজা কাঁদতে কাঁদতে এসে রাজামশাইয়ের পায়ে পড়ে মাপ চাইল।
রাজামশাই জোলাকে দেখিয়ে বললেন,‘ আর এই লোকটিকে যদি তোমার অর্ধেক রাজ্য দাও, আর তার সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দাও, তা হলে তোমার মাপ করব।’
সে ত তার সব রাজ্যই দিতে চেয়েছিল। কাজেই জোলাকে তার অর্ধেক রাজ্য আর মেয়ে দিতে তখনি রাজি হল।
তারপর জোলা সেই অর্ধেক রাজ্যের রাজা হল,আর রাজার মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হল। আর ভোজের কি যেমন তেমন ঘটা হল! সে ভোজ খেয়ে যদি তারা শেষ করতে না পেরে থাকে, তবে হয়ত এখনো খাচেছ। সেখানে একবার যেতে পারলে হত।