Pages

Saturday, August 30, 2014

পোস্টমাস্টার : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারকে আসিতে হয়। গ্রামটি অতি সামান্য। নিকটে একটি নীলকুঠি আছে, তাই কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নূতন পোস্টআপিস স্থাপন করাইয়াছে।

আমাদের পোস্টমাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যে-রকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্টমাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে তাঁহার আপিস; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল। কুঠির গোমস্তা প্রভৃতি যে-সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্রায় নাই এবং তাহার ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে।

বিশেষত কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হইয়া থাকে। এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাঁহার মেলামেশা হইয়া উঠে না। অথচ হাতে কাজ অধিক নাই। কখনো-কখনো দুটো-একটা কবিতা লিখিতে চেষ্টা করেন। তাহাতে এমন ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, সমস্ত দিন তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ দেখিয়া জীবন বড়ো সুখে কাটিয়া যায়– কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলা কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয় এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।

পোস্টমাস্টারের বেতন অতি সামান্য। নিজে রাঁধিয়া খাইতে হয় এবং গ্রামের একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা তাঁহার কাজকর্ম করিয়া দেয়, চারিটি-চারিটি খাইতে পায়। মেয়েটির নাম রতন। বয়স বারো-তেরো। বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না।

সন্ধ্যার সময় যখন গ্রামের গোয়ালঘর হইতে ধূম কুণ্ডলায়িত হইয়া উঠিত, ঝোপে ঝোপে ঝিল্লি ডাকিত, দূরে গ্রামের নেশাখোর বাউলের দল খোল-করতাল বাজাইয়া উচ্চৈঃস্বরে গান জুড়িয়া দিত– যখন অন্ধকার দাওয়ায় একলা বসিয়া গাছের কম্পন দেখিলে কবিহৃদয়েও ঈষৎ হৃৎকম্প উপস্থিত হইত তখন ঘরের কোণে একটি ক্ষীণশিখা প্রদীপ জ্বালিয়া পোস্টমাস্টার ডাকিতেন “রতন”। রতন দ্বারে বসিয়া এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত কিন্তু এক ডাকেই ঘরে আসিত না– বলিত, “কী গা বাবু, কেন ডাকছ।”

পোস্টমাস্টার। তুই কী করছিস।

রতন। এখনই চুলো ধরাতে যেতে হবে– হেঁশেলের–

পোস্টমাস্টার। তোর হেঁশেলের কাজ পরে হবে এখন– একবার তামাকটা সেজে দে তো।

অনতিবিলম্বে দুটি গাল ফুলাইয়া কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে রতনের প্রবেশ। হাত হইতে কলিকাটা লইয়া পোস্টমাস্টার ফস্‌ করিয়া জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা রতন, তোর মাকে মনে পড়ে?” সে অনেক কথা; কতক মনে পড়ে, কতক মনে পড়ে না। মায়ের চেয়ে বাপ তাহাকে বেশি ভালোবাসিত, বাপকে অল্প অল্প মনে আছে। পরিশ্রম করিয়া বাপ সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরিয়া আসিত, তাহারই মধ্যে দৈবাৎ দুটি-একটি সন্ধ্যা তাহার মনে পরিষ্কার ছবির মতো অঙ্কিত আছে। এই কথা হইতে হইতে ক্রমে রতন পোস্টমাস্টারের পায়ের কাছে মাটির উপর বসিয়া পড়িত। মনে পড়িত, তাহার একটি ছোটোভাই ছিল– বহু পূর্বেকার বর্ষার দিনে একদিন একটা ডোবার ধারে দুইজনে মিলিয়া গাছের ভাঙা ডালকে ছিপ করিয়া মিছামিছি মাছধরা খেলা করিয়াছিল– অনেক গুরুতর ঘটনার চেয়ে সেই কথাটাই তাহার মনে বেশি উদয় হইত। এইরূপ কথাপ্রসঙ্গে মাঝে মাঝে বেশি রাত হইয়া যাইত, তখন আলস্যক্রমে পোস্টমাস্টারের আর রাঁধিতে ইচ্ছা করিত না। সকালের বাসী ব্যঞ্জন থাকিত এবং রতন তাড়াতাড়ি উনুন ধরাইয়া খানকয়েক রুটি সেঁকিয়া আনিত– তাহাতেই উভয়ের রাত্রের আহার চলিয়া যাইত।

এক-একদিন সন্ধ্যাবেলায় সেই বৃহৎ আটচালার কোণে আপিসের কাঠের চৌকির উপর বসিয়া পোস্টমাস্টারও নিজের ঘরের কথা পাড়িতেন– ছোটোভাই, মা এবং দিদির কথা, প্রবাসে একলা ঘরে বসিয়া যাহাদের জন্য হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিত তাহাদের কথা। যে-সকল কথা সর্বদাই মনে উদয় হয় অথচ নীলকুঠির গোমস্তাদের কাছে যাহা কোনোমতেই উত্থাপন করা যায় না, সেই কথা একটি অশিক্ষিতা ক্ষুদ্র বালিকাকে বলিয়া যাইতেন, কিছুমাত্র অসংগত মনে হইত না। অবশেষে এমন হইল, বালিকা কথোপকথনকালে তাঁহার ঘরের লোকদিগকে মা, দিদি, দাদা বলিয়া চিরপরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করিত। এমন-কি, তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়পটে বালিকা তাঁহাদের কাল্পনিক মূর্তিও চিত্রিত করিয়া লইয়াছিল।

একদিন বর্ষাকালে মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস দিতেছিল, রৌদ্রে ভিজা ঘাস এবং গাছপালা হইতে একপ্রকার গন্ধ উত্থিত হইতেছিল, মনে হইতেছিল যেন ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিশ্বাস গায়ের উপরে আসিয়া লাগিতেছে, এবং কোথাকার এক নাছোড়বান্দা পাখি তাহার একটা একটানা সুরের নালিশ সমস্ত দুপুরবেলা প্রকৃতির দরবারে অত্যন্ত করুণস্বরে বার বার আবৃত্তি করিতেছিল। পোস্টমাস্টারের হাতে কাজ ছিল না– সেদিনকার বৃষ্টিধৌত মসৃণ চিক্কণ তরুপল্লবের হিল্লোল এবং পরাভূত বর্ষার ভগ্নাবশিষ্ট রৌদ্রশুভ্র স্তূপাকার মেঘস্তর বাস্তবিকই দেখিবার বিষয় ছিল; পোস্টমাস্টার তাহা দেখিতেছিলেন এবং ভাবিতেছিলেন, এই সময়ে কাছে একটি-কেহ নিতান্ত আপনার লোক থাকিত– হৃদয়ের সহিত একান্তসংলগ্ন একটি স্নেহপুত্তলি মানবমূর্তি। ক্রমে মনে হইতে লাগিল, সেই পাখি ঐ কথাই বার বার বলিতেছে এবং এই জনহীন তরুচ্ছায়ানিমগ্ন মধ্যাহ্নের পল্লবমর্মরের অর্থও কতকটা ঐরূপ। কেহ বিশ্বাস করে না, এবং জানিতেও পায় না, কিন্তু ছোটো পল্লীর সামান্য বেতনের সাব-পোস্টামাস্টারের মনে গভীর নিস্তব্ধ মধ্যাহ্ন দীর্ঘ ছুটির দিনে এইরূপ একটা ভাবের উদয় হইয়া থাকে।

পোস্টামাস্টার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ডাকিলেন, “রতন”। রতন তখন পেয়ারাতলায় পা ছড়াইয়া দিয়া কাঁচা পেয়ারা খাইতেছিল; প্রভুর কন্ঠস্বর শুনিয়া অবিলম্বে ছুটিয়া আসিল– হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “দাদাবাবু, ডাকছ?” পোস্টমাস্টার বলিলেন, “তোকে আমি একটু একটু করে পড়তে শেখাব।” বলিয়া সমস্ত দুপুরবেলা তাহাকে লইয়া “স্বরে অ” “স্বরে আ” করিলেন। এবং এইরূপে অল্পদিনেই যুক্ত-অক্ষর উত্তীর্ণ হইলেন।

শ্রাবণমাসে বর্ষণের আর অন্ত নাই। খাল বিল নালা জলে ভরিয়া উঠিল। অহর্নিশি ভেকের ডাক এবং বৃষ্টির শব্দ। গ্রামের রাস্তায় চলাচল প্রায় একপ্রকার বন্ধ– নৌকায় করিয়া হাটে যাইতে হয়।

একদিন প্রাতঃকাল হইতে খুব বাদলা করিয়াছে। পোস্টমাস্টারের ছাত্রীটি অনেকক্ষণ দ্বারের কাছে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল, কিন্তু অন্যদিনের মতো যথাসাধ্য নিয়মিত ডাক শুনিতে না পাইয়া আপনি খুঙ্গিপুঁথি লইয়া ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, পোস্টমাস্টার তাঁহার খাটিয়ার উপর শুইয়া আছেন– বিশ্রাম করিতেছেন মনে করিয়া অতি নিঃশব্দে পুনশ্চ ঘর হইতে বাহিরে যাইবার উপক্রম করিল। সহসা শুনিল “রতন”। তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গিয়া বলিল, “দাদাবাবু, ঘুমোচ্ছিলে?” পোস্টমাস্টার কাতরস্বরে বলিলেন, “শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না– দেখ্‌ তো আমার কপালে হাত দিয়ে।”

এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাসে ঘনবর্ষায় রোগকাতর শরীরে একটুখানি সেবা পাইতে ইচ্ছা করে। তপ্ত ললাটের উপর শাঁখাপরা কোমল হস্তের স্পর্শ মনে পড়ে। এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারীরূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন, এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে। এবং এস্থলে প্রবাসীর মনের অভিলাষ ব্যর্থ হইল না। বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল, এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।”

বহুদিন পরে পোস্টমাস্টার ক্ষীণ শরীরে রোগশয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিলেন– মনে স্থির করিলেন, আর নয়, এখান হইতে কোনোমতে বদলি হইতে হইবে। স্থানীয় অস্বাস্থ্যের উল্লেখ করিয়া তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় কর্তৃপক্ষদের নিকট বদলি হইবার জন্য দরখাস্ত  করিলেন।

রোগসেবা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া রতন দ্বারের বাহিরে আবার তাহার স্বস্থান অধিকার করিল। কিন্তু পূর্ববৎ আর তাহাকে ডাক পড়ে না; মাঝে মাঝে উঁকি মারিয়া দেখে, পোস্টমাস্টার অত্যন্ত অন্যমনস্কভাবে চৌকিতে বসিয়া অথবা খাটিয়ায় শুইয়া আছেন। রতন যখন আহ্বান প্রত্যাশা করিয়া বসিয়া আছে, তিনি তখন অধীরচিত্তে তাঁহার দরখাস্তের উত্তর প্রতীক্ষা করিতেছেন। বালিকা দ্বারের বাহিরে বসিয়া সহস্রবার করিয়া তাহার পুরানো পড়া পড়িল। পাছে যেদিন সহসা ডাক পড়িবে সেদিন তাহার যুক্ত-অক্ষর সমস্ত গোলমাল হইয়া যায়, এই তাহার একটা আশঙ্কা ছিল। অবশেষে সপ্তাহখানেক পরে একদিন সন্ধ্যাবেলায় ডাক পড়িল। উদ্‌বেলিতহৃদয়ে রতন গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “দাদাবাবু, আমাকে ডাকছিলে?”

পোস্টমাস্টার বলিলেন, “রতন, কালই আমি যাচ্ছি।”

রতন।  কোথায় যাচ্ছ, দাদাবাবু।

পোস্টমাস্টার।  বাড়ি যাচ্ছি।

রতন।  আবার কবে আসবে।

পোস্টমাস্টার।  আর আসব না।

রতন আর-কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না। পোস্টমাস্টার আপনিই তাহাকে বলিলেন, তিনি বদলির জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলেন, দরখাস্ত নামঞ্জুর হইয়াছে; তাই তিনি কাজে জবাব দিয়া বাড়ি যাইতেছেন। অনেকক্ষণ আর কেহ কোনো কথা কহিল না। মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং একস্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপ টপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।

কিছুক্ষণ পরে রতন আস্তে আস্তে উঠিয়া রান্নঘরে রুটি গড়িতে গেল। অন্যদিনের মতো তেমন চটপট হইল না। বোধ করি মধ্যে মধ্যে মাথায় অনেক ভাবনা উদয় হইয়াছিল। পোস্টমাস্টারের আহার সমাপ্ত হইলে পর বালিকা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?”

পোস্টমাস্টার হাসিয়া কহিলেন, “সে কী করে হবে।” ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব তাহা বালিকাকে বুঝানো আবশ্যক বোধ করিলেন না।

সমস্ত রাত্রি স্বপ্নে এবং জাগরণে বালিকার কানে পোস্টমাস্টারের হাস্যধ্বনির কন্ঠস্বর বাজিতে লাগিল– “সে কী করে হবে’।

ভোরে উঠিয়া পোস্টমাস্টার দেখিলেন, তাঁহার স্নানের জল ঠিক আছে; কলিকাতার অভ্যাস অনুসারে তিনি তোলা জলে স্নান করিতেন। কখন তিনি যাত্রা করিবেন সে কথা বালিকা কী কারণে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই; পাছে প্রাতঃকালে আবশ্যক হয় এইজন্য রতন তত রাত্রে নদী হইতে তাঁহার স্নানের জল তুলিয়া আনিয়াছিল। স্নান সমাপন হইলে রতনের ডাক পড়িল। রতন নিঃশব্দে গৃহে প্রবেশ করিল এবং আদেশপ্রতীক্ষায় একবার নীরবে প্রভুর মুখের দিকে চাহিল। প্রভু কহিলেন, “রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন তাঁকে বলে দিয়ে যাব তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন, আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।” এই কথাগুলি যে অত্যন্ত স্নেহগর্ভ এবং দয়ার্দ্র হৃদয় হইতে উত্থিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু নারীহৃদয় কে বুঝিবে। রতন অনেকদিন প্রভুর অনেক তিরস্কার নীরবে সহ্য করিয়াছে কিন্তু এই নরম কথা সহিতে পারিল না। একেবারে উচ্ছ্বসিতহৃদয়ে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, “না না, তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি থাকতে চাই নে।”

পোস্টমাস্টার রতনের এরূপ ব্যবহার কখনো দেখেন নাই, তাই অবাক হইয়া রহিলেন।

নূতন পোস্টমাস্টার আসিল। তাহাকে সমস্ত চার্জ বুঝাইয়া দিয়া পুরাতন পোস্টমাস্টার গমনোন্মুখ হইলেন। যাইবার সময় রতনকে ডাকিয়া বলিলেন, “রতন, তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারি নি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিনকয়েক চলবে।”

কিছু পথখরচা বাদে তাঁহার বেতনের যত টাকা পাইয়াছিলেন পকেট হইতে বাহির করিলেন। তখন রতন ধুলায় পড়িয়া তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্যে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না”– বলিয়া একদৌড়ে সেখান হইতে পলাইয়া গেল।

ভূতপূর্ব পোস্টমাস্টার নিশ্বাস ফেলিয়া হাতে কার্পেটের ব্যাগ ঝুলাইয়া, কাঁধে ছাতা লইয়া, মুটের মাথায় নীল ও শ্বেত রেখায় চিত্রিত টিনের পেঁটরা তুলিয়া ধীরে ধীরে নৌকাভিমুখে চলিলেন।

যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন– একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, “ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি”- কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে- এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।

কিন্তু রতনের মনে কোনো তত্ত্বের উদয় হইল না। সে সেই পোস্টআপিস গৃহের চারি দিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বোধ করি তাহার  মনে ক্ষীণ আশা জাগিতেছিল, দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে– সেই বন্ধনে পড়িয়া কিছুতেই দূরে যাইতে পারিতেছিল না। হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।

Wednesday, July 16, 2014

কুঁজো আর ভূত

কানাই বলে একটি লোক ছিল, তার পিঠে তার পিঠে ছিল ভয়ঙ্কর একটা কৃঁজ। বেচারা বড্ড ভালমানুষ ছিল, লোকের অসুখ-বিসুখে ওষুধপত্র দিয়ে তাদের কত উপকার করত। কিন্তু কুঁজো বলে তাকে কেউ ভালবাসত না।
কানাইয়ের ঝুড়ির দোকান লোক ছিল। আর কোনো ঝুড়িওয়ালা তার মত ঝুড়ি বুনতে পারত না। তারা তাকে ভারি হিংসা করত, আর তার নামে যা-তা বলে বেড়াত। তা শুনে লোকে ভাবত, কানাই বড় দুষ্টু লোক। তাকে দেখতে পেলে সকলে মুখ ফিরিয়ে থাকত। বেচারার দুঃখের সীমাই ছিল না।
এত বড় কুঁজ নিয়ে মাথা গুঁজে চলতে কানাইয়ের বড়ই কষ্ট হত। একদিন সে একটু দূরে এক জায়গায় ঝুড়ি বেচতে গেল, আর দিন থাকতে ঘরে ফিরতে পারল না। পথে একটা পুরনো বাড়ির কাছে এসে এমনি অন্ধকার হল, আর তার এতই কাহিল বোধ হল যে, আর চলা অসম্ভব। সে জায়গাটা ভারি বিশ্রী; লোকে প্রাণান্তেও সে পথে আসতে চায় না। বলে, ওটা ভূদের বাড়ি। কিন্তু কানাইয়ের বড্ডই পরিশ্রম হয়েছে, চলবার আর সাধ্য নেই। কাজেই সে সেখানে পথের পাশে একটু না বসে আর কি করি?
কতত্ষণ সে এভাবে বসে ছিল তার কিন্তু ঠিক নেই। বসে থাকতে থাকতে তার মনে হল, যেন সেই পুরনো বাড়িটার ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে অনেকগুলো গলা মেলে। আহা, কি সুন্দর সুরেই গাইছে। শুনে কানাইয়ের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সে অবাক হয়ে শুনতেই লাগল। গানের সুরটি অতি আশ্চর্য, কিন্তু কথা এইটুকুঃ
‘লুন হ্যায়,তেল হ্যায়, ইম্‌লী হ্যায়, হিং হ্যায়!’
শুনতে শুনতে কানাই একেবারে মেতে গেল। সে ভাবল যে তারও গানটা না গাইলেই চলছে না। কাজেই সেও খুব করে গলা ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে ধরলঃ
‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইম্‌লী হ্যায়, হিং হ্যায়!’
এইটুকুই গেয়েই ঝাঁ করে তার বুদ্ধি খুলে গেল, সে আরো উঁচু সুরে গাইল
‘লসুন হ্যায়, মরীচ হ্যায়, চ্যাং ব্যাং শুঁটকি হ্যায়।’
কানাই এই কথাগুলো খুব গলা ছেড়েই গেয়েছিল। সে গলার আওয়াজ যে সেই বাড়ির ভিতরের গাইয়েদের কানে গিয়ে পৌঁছিয়েছিল, তাতে আর কোন ভুল নেই। সে গাইয়েগুলো ছিল অবশ্য ভূত। তারা সেই নূতন কথাগুলো শুনে এতই খুশি হল যে, তখনই ছুটে কানাইয়ের কাছে না এসে আর থাকতে পারল না। তারা এসে কানাইকে কোলে করে নাচতে নাচতে সেই বাড়ির ভিতরে বেয়ে গেল, আর যে আদরটা করল! মিঠাই যে তাকে কত খাওয়াল, তার অন্ত নেই। তারপর সকলে মেলে নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলঃ
‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইম্‌লী হ্যায়, হিং হ্যায়!’ ‘লসুন হ্যায়, মরীচ হ্যায়, চ্যাং ব্যাং শুঁটকি হ্যায়।’
কানাইকেও তাদের সঙ্গে নেচে নেচে গানটি গাইতে হল। তখন তার মনে হল, ‘কি আশ্চর্য, আমি কুঁজ নিয়ে চলতে পারি না, আমি আবার নাচলুম কি করে?’ বলতে বলতেই তার হাতখানি পিঠের দিকে গেল-এ কি? তার সে কুঁজ যে আর নেই! একজন ভূত বলল, ‘কি, দেখছিস বাপ? ওটা আর ওখানে নেই। ঐ দেখ, তোর পাশে পড়ে আছে।’
সত্যি সত্যে সে কুঁজ আর কানাইয়ের পিঠে ছিল না, তখন তার পাশে পড়ে ছিল। আহা! কানাইয়ের তখন কি অনন্দই হল। আর হালকা আর আরাম বোধ হল এমনি যে, সে তখনই সেইখানে মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর যখন পরদিন সকালে তার ঘুম ভাঙল, তখন সে দেখল যে সেই বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে শুয়ে আছে। ভূতেরা তাকে একটি চমৎকার নূতন পোশাক পরিয়ে সেখানে এনে রেখে গিয়েছে। তখন সে তাড়াতাড়ি উঠে, মনের সুখে বাড়ি চলে এল। সেখানকার লোকেরা তার মুখের পানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, কেউ তাকে চিনতে পারে না। সে যে তাদের সেই কুঁজো কানাই, ভূতেরা তার কুঁজ ফেলে তার এমনি সুন্দর চেহারা করে দিয়েছে, এ কথা তাদের বোঝাতে তার অনেকক্ষণ লেগেছিল।
তারপর দেখতে দেখতে কানাইয়ের কুঁজের গল্প দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। যে শুনল, সেই ভাবল যে, এমন আশ্চর্য কথা আর কখনো শোনে নি। এখন আর লোকে তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে থাকে না; তারা হাসতে হাসতে ছুটে এসে তার সঙ্গে কথা কয়, আর বাড়ির লোককে তার এই আশ্চর্য খবর শোনাবার জন্য তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়। কত লোকে শুধু সেই গল্প শোনাবার জন্যই তার ঝুড়ি কিনতে আসে। ঝুড়ি বেচে সে বড়লোক হয়ে গেল।
এমনি করি দিন যাচ্ছে। তারপর একদিন কানাই তার ঘরের দাওয়ায় বসে ঝুড়ি বুনছে, এমন সময় একটি বুড়ি সেই পথে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাগো, কেবলহাটি যাব কোন পথে? কানাই বললে, ‘এই ত কেবলহাটি। তুমি কি চাও?’ বুড়ি বলল, ‘তোমাদের গ্রামে নাকি কানাই বলে কে আছে, ভুতেরা তার কুঁজ সারিয়ে দিয়েছিল। তার মন্তরটা তার কাছ থেকে শিখে নিতে পারলে আমাদের মানিকের কুঁজটাও সারিয়ে নিতুম।’
কানাই বলল, ‘আমি ত সেই কানাই ভূতেরা আমারই কুঁজ সারিয়ে দিয়েছিল। এর ত মন্তর-টন্তর কিছু নেই, তারা রাত জেগে গাইছিল, আমি পথের ধারে শুয়ে শুয়ে তাদের গানে নতুন কথা জুড়ে দিয়েছিলাম। তাইতে তারা খুশি হয়ে আমার কুঁজ সারিয়ে, নূতন পোশাক পরিয়ে দিয়েছিল।’ বুড়ি তখন খুঁটে খুঁটে সব কানাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিয়ে তাকে অনেক আশীর্বাদ করে সেখান থেকে চলে গেল।
সেই বুড়ির ছেলে যে মানিক, তার পিঠে ছিল কানাইয়ের কুঁজের চেয়েও ঢের বড় একটা কুঁজ। লোকটা এমনি দুষ্ট আর হিংসুটে ছিল যে পাড়ার লোকে তার জ্বালায় অস্থির থাকত। সেই মানিকের কুঁজ সারাবার জন্য তার বাড়ির লোকেরা একদিন রাত্রে তাকে গাড়ি করে এরে ভূতের বাড়ির কাছে রেখে গেল। সেখানে পড়ে পড়ে মানিক ভাবছে, ভূতেরা কখন গান ধরবে, আর তাতে সে কথা জুড়ে দেবে, আর তার কুঁজ সেরে গাবে। তারপর যেই ভূতেরা বলেছেঃ ‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায় , ইম্‌লী হ্যায়,’ অমনি মানিক আর তাদের শেষ করতে না দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘গুরুচরণ ময়রার দোকানের কাঁচা গোল্লা হ্যায়।’
তখন গানের তাল ভেঙে ত গেলই, কাঁচাগোল্লার নাম শুনে অনেক ভূতের বমি পর্যন্ত হতে লাগল। ভূতেরা এ সব জিনিসকে বড্ড ঘৃণা করে, এর নাম অবধি শুনতে পারে না। কাজেই তারা তাতে বেজায় চটে দাঁত খিঁচুতে খিচুতে এসে বললম ‘কে রে তুই অসভ্য বেতালা বেটা, আমাদের গান মাটি করে দিলি? দাঁড়া তোকে দিখাচ্ছি!’ এই বলে তারা কানাইয়ের সেই কুঁজটা এনে মানিকের কুঁজের উপর বসিয়ে এমনি করে জুড়ে দিল যে আর কিছুতেই তাকে তাকে তুলবার জো নেই।
পরদিন মানিকের বাড়ির লোকেরা এসে তাকে দেখে অবশ্য খুবই আশ্চর্য আর দুঃখিত হল। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলল, ‘বেটা যেমন দুষ্টু, তেমনি সাজা হয়েছে।’

Saturday, July 12, 2014

নাপিত পণ্ডিত

বাগদাদ শহরে এক ধনীর ছেলে প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিল— সে কাজীর মেয়েকে বিবাহ করিবে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করা যত সহজ, কাজটা তত সহজ নয়— সুতরাং কিছুদিন চেষ্টা করিয়াই সে বেচারা একেবারে হতাশ হইয়া পড়িল। দিনে আহার নাই, রাত্রে নিদ্রা নাই— তার কেবলই ঐ এক চিন্তা— কী করিয়া কাজীর মেয়েকে বিবাহ করা যায়।

বিবাহের সব চাইতে বড় বাধা কাজী সাহেব স্বয়ং। সকলেই বলে, "বাপু হে! কাজী সাহেব এ স্পর্ধার কথা জানতে পারলে তোমার একটি হাড় আস্ত রাখবেন না।" বেচারা কী করে? ক্রমাগত ভাবিয়া-চিন্তিয়া সে রীতিমত জ্বর আনিয়া ফেলিল— বন্ধু-বান্ধব বলিতে লাগিল, "ছোকরা বাঁচলে হয়।" ইহার মধ্যে হঠাৎ একদিন এক বুড়ি আসিয়া খবর দিল, বিবাহের সমস্তই ঠিক। কাজী সাহেবকে না জানাইয়াই এখন চুপচাপ বিবাহটা হইয়া যাক— তারপর সুবিধামত তাঁহাকে খবর দেওয়া যাইবে; তখন তিনি গোল করিয়া করিবেন কি? সে আরও বলিল, "শুক্রবার সন্ধ্যার সময় কাজী সাহেব বাড়ি থাকবেন না— সেই সময় বিয়েটা সেরে ফেল— কিন্তু খবরদার! কাজীসাহেব যেন এসব কথার বিন্দুমাত্র জানতে না পারেন।"

শুক্রবার দিন ভোর না হইতে বর বেচারা হাত মুখ ধুইয়া প্রস্তুত, সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহার আর সবুর সয় না। দুপুর না হইতেই সে চাকরকে বলিল, "একতা নাপিত ডেকে আন্‌। এখন থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকি।" চাকর তাড়াতাড়ি কোথ হইতে এক নাপিত আনিয়া হাজির করিল।

নাপিত আসিয়াই বরকে বলিল, "আপনাকে বড় কাহিল দেখছি— যদি অনুমতি করেন ত' ছুরি দিয়ে বাঁ হাতের একটুখানি রক্ত ছাড়িয়ে দিই— তা হলেই সমস্ত শরীরটা ঠান্ডা বোধ করবেন।" বর বলিল, "না হে, তোমাকে চিকিৎসার জন্য ডাকি নাই— আমার দাড়িতা একটু চট্‌পট্‌ কামিয়ে দাও দেখি।" নাপিত তখন তাহার সরঞ্জামের থলি খুলিয়া অনেকগুলা ক্ষুর বাহির করিল, তারপর প্রত্যেকটা ক্ষুর হাতে লইয়া বার বার পরীক্ষা করিতে লাগিল। এইরূপে অনেক সময় নষ্ট করিয়া সে একটা বাটির মত কী একটা বাহির করিল। বর ভাবিল, এইবার বাটিতে জল দিয়া কামান শুরু করিবে। কিন্তু নাপিত তাহার কিছুই করিল না; সে অদ্ভুত একটা কাঁটা-কম্পাসের মানযন্ত্র লইয়া ঘরের বাহিরে উঠানের মাঝখানে গিয়া, সূর্যের গতিবিধির কী সব হিসাব করিতে লাগিল। তারপর আবার গম্ভীরভাবে ঘরে আসিয়া বলিল, "মহাশয়, হিসাব ক'রে দেখলাম, এই বৎসর এই মাসে এই শুক্রবারের ঠিক এই সময়টি অতি চমৎকার শুভক্ষণ— দাড়ি কামাবার উপযুক্ত সময়। কিন্তু আজ মঙ্গল বুধ গ্রহসংযোগ হওয়াতে আপনার কিছু বিপদের সম্ভাবনা দেখছি।"

কাজের সময় এরকম বক্‌বক্‌ কারিলে কাহার না রাগ হয়? বিবাহার্থী ছোকরাটি রাগিয়া বলিল, "বাপু হে, তোমাকে কি বক্তৃতা শোনাবার জন্য না জ্যোতিষ গণনার জন্য ডাকা হয়েছে? কামাতে এসেছ, কামিয়ে যাও।" কিন্তু নাপিত ছাড়িবার পাত্রই নয়, সে অভিমান করিয়া বলিল, "মশাই, এ রকম অন্যায় রাগ আপনার শোভা পায় না। আপনি জানেন আমি কে? আপনি কি জানেন যে বাগদাদ শহরে আমার মত দ্বিতীয় আর কেউ নাই? আমার গুণের কথা শুনবেন? আমি একজন বিচক্ষণ চিকিৎসক, রসায়ন শাস্ত্রে আমার অসাধারণ দখল, আমার জ্যোতিষ গণনা একেবারে নির্ভুল, নীতিশাস্ত্র ব্যাকরণশাস্ত্র তর্কশাস্ত্র, এ সমস্তই আমার কণ্ঠস্থ, জ্যামিতি থেকে শুরু ক'রে বীজগণিত পাটিগণিত পর্যন্ত গণিতশাস্ত্রের কোন তত্ত্বি জানতে বাকি রাখি নি। তার উপর আবার আমি একজন পাকা দার্শনিক পণ্ডিত, আর আমি যে সকল কবিতা রচনা করি, সমঝদার লোকের মুখে তার সুখ্যাতি আর ধরে না।"— নাপিতের এই বক্তৃতার দৌড় দেখিয়া ছোকরাটি ভীষণ রাগের মধ্যেও হাসিয়া ফেলিল। সে বলিল, "তোমার বক্তৃতা শুনবার ফুরসৎ আমার নাই— তুমি কামান শেষ করবে কি না বল, না কর চলে যাও।" নাপিত বলিল, "এই কি আপনার উপযুক্ত কথা হল? আমি কি আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম, না আপনি নিজেই লোক পাঠিয়ে আমাকে ডাকিয়েছিলেন? এখন আমি আপনাকে না কামিয়ে গেলে, আমার মান সম্ভ্রম থাকে কি ক'রে? আপনি সেদিনকার ছেলে, আপনি এসবের কদর বুঝবেন কি? আপনার বাবা যদি আজ থাকতেন তবে আমাকে ধন্য ধন্য বলতেন— কারণ তাঁর কাছে কোন দিনই আমার সম্মানের ত্রুটি হয়নি। আমার এ সকল আমূল্য উপদেশ শুনবার সৌভাগ্য সকলে পায় না— তিনি তা বেশ বুঝতেন। আহা, তিনি কী চমৎকার লোকই ছিলেন! আমার কথাগুলি কত আগ্রহ ক'রে তিনি শুনতেন! আর কত খাতির, কত তোয়াজ ক'রে কত অজস্র বকশিস্‌ দিয়ে তিনি আমায় খুসি রাখতেন। আপনি ত' সে সব খবর রাখেন না।" এই রকম বক্তৃতায় সে আরও আধঘণ্টা সময় কাটাইয়া দিল। এদিকে বেলাও বাড়িতেছে, বিবাহের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে; কাজেই বর একেবারে সপ্তমে চড়িয়া বলিল, "যাও! যাও! তোমায় কামাতে হবে না।"

নাপিত তখন তাড়াতাড়ি ক্ষুর লইয়া কামাইতে শুরু করিল। কিন্তু ক্ষুরের দুই চার টান দিয়াই সে আবার থামিয়া বলিল, "মশাই! ওরকম রাগ করা ভাল নয়। ভেবে দেখুন, জ্ঞানে গুণে বয়সে সব বিষয়েই আপনি ছেলেমানুষ। তবে অবশ্যি, আপনার যে রকম তাড়া দেখছি, তাতে বোধহয় আপনি আজকে একটু বিশেষ ব্যস্ত আছেন। এ রকম ব্যস্ততার কারণটা কী জানতে পারলে, আমি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে ঠিক ভালমত ব্যবস্থা করতে পারি।" এই বলিয়াই সে আবার তাহার মানযন্ত্র লইয়া হিসাব করিতে লাগিল। যতই তাড়া দেওয়া যায়, ততই সে বলে, "এই হিসাবটা হল ব'লে।" তখন বেগিতিক দেখিয়া বর বলিল, "আরে, ব্যাপারটা কিছু নয়— আজ রাত্রে আমার এক জায়গায় নিমন্ত্রণ আছে— তাই, বড় তাড়াতাড়ি।"

এই কথা শুনিবা মাত্র নাপিত একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। সে বলিল, "ভাগ্যিস্‌ মনে করিয়ে দিলেন! আমার বাড়িতেও যে আজ ছয়জন লোককে নেমন্তন্ন করে এসেছি! তাদের জন্য ত' কোনরকম বন্দোবস্ত ক'রে আসি নি। এখন, মনে করুন, মাংস কিনতে হবে, রাঁধবার ব্যবস্থা করতে হবে, মিঠাই আনতে হবে;— কখন বা এসব করি, আর কখনই বা আপনাকে কামাই।" বর দেখিল আবার বেগতিক, সে নিরুপায় হইয়া বলিল, "দোহাই তোমার। আর আমায় ঘাঁটিও না— আমার চাকরকে বলে দিচ্ছি— তোমার যা কিছু চাই আমার ভাঁড়ার থেকে সমস্তই সে বা'র ক'রে দেবে— তার জন্য তুমি মিথ্যে ভেব না।" নাপিত বলিল, "এ অতি চমৎকার কথা। দেখুন, হামামের মালিশওয়ালা জান্তৌৎ— আর ঐ যে কড়াইশুঁটি বিক্রী করে, সালি— আর ঐ শিম বেচে, সালৌৎ— আর আখের শা তরকারিওয়ালা আর আবু মেকারেজ ভিস্তি আর পাহারাদার কাশেম— এরা সবাই ঠিক আমার মত আমুদে— এরা কখনও মুখ হাঁড়ি করে থাকে না; তাই এদের আমি নেমন্তন্ন করেছি। আর এদের একটা বিশেষ গুণ যে, এরা ঠিক আমারই মত চুপচাপ থাকে— বেশী বক্‌বক্‌ করতে ভাল বাসে না। এক একজন লোক থাকে তারা সব সময়েই বকর্‌ বকর্‌ করছে— আমি তাদের দু চক্ষে দেখতে পারি নে। এরা কেউ সেরকম নয়; তবে নাচতে আর গাইতে এরা সবাই ওস্তাদ। জান্তৌৎ কি রকম ক'রে নাচে দেখবেন? ঠিক এই রকম"— এই বলিয়া সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নৃত্য ও বিকট সুরে গান করিতে লাগিল। কেবল তাহাই নয়, ঐ ছয়জন বন্ধুর মধ্যে প্রত্যেকে কি রকম করিয়া নাচে ও গায়, তাহার নকল দেখাইয়া তবে সে ছাড়িল। তারপর, হঠাৎ সে ক্ষুরটুর ফেলিয়া ভাঁড়ার ঘরে চাকরের কাছে তাহার নিমন্ত্রণের ফর্দ দিতে ছুটিল। বর ততক্ষণে আধ কামান অবস্থায় ক্ষেপিয়া পাগলের মত হইয়াছে, কিন্তু নাপিত তাহার কথায় কানও দেয় না। সে গম্ভীরভাবে ঘরের হাঁস মুরগী তরিতরকারি হালুয়া মিঠাই সব বাছিয়া বাছিয়া পছন্দ করিতে লাগিল। তারপর আরও অনেক গল্প আর অনেক উপদেশ শুনাইয়া অতি ধীর মেজাজে সাড়ে চার ঘণ্টায় সে তাহার কামান শেষ করিল। আবার যাইবার সময় বলিয়া গেল, "দেখুন, আমার মত এমন বিজ্ঞ, এমন শান্ত, এমন অল্পভাষী হিতৈষী বন্ধু আপনি পেয়েছেন, সেটা কেবল আপনার বাবার পুণ্যে। আজ হ'তে আমি আপনার কেনা হয়ে রইলুম।"

নাপিতের হাত হইতে উদ্ধার পাইয়া বর দেখিল, আর সময় নাই। সে তাড়াতাড়ি বিবাহ করিতে বাহির হইল। লোকজন সঙ্গে লইল না, এবং কাহাকেও খবর দিল না; পাছে কথাটা কোন গতিকে কাজী সাহেবের কাছে ফাঁস হইয়া যায়।

এদিকে নাপিতও কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকে নাই। সে কেবল ভাবিতেছে, "না জানি সে কি রকম নেমন্তন্ন, যার জন্য সে এমন ব্যস্ত, যে আমার ভাল ভাল কথাগুলো পর্যন্ত শুনতে চায় না। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।" সুতরাং বর যখন সন্ধ্যার সময় বাহির হইল, নাপিতও তাহার পিছন পিছন লুকাইয়া চলিল।

বর সাবধানে কাজীর বাড়ি হাজির হইয়া খবর লইল যে কাজীসাহেব বাড়িতে নাই; এদিকে সব আয়োজন প্রস্তুত— তাড়াতাড়ি বিবাহ সারিতে হইবে। দৈবাৎ যদি কাজীসাহেব আসিয়া পড়েন, তাহার জন্য ছাতের উপর পাহারা বসান হইল, তাঁহাকে আসিতে দেখিলেই সে চিৎকার করিয়া সঙ্কেত করিবে এবং বরকে খিড়কী দরজা দিয়া পলাইতে হইবে। এদিকে কিন্তু হতভাগা নাপিতটা বাড়ির বাহিরে থাকিয়া যে আসে তাহাকেই বলে, "তোমরা সাবধানে থেক— আমাদের মনিবটি কেন জানই এই কাজীর বাড়িতে ঢুকেছেন— তাঁর জন্য আমার বড় ভাবনা হচ্ছে।"

বিবাহ আরম্ভ না হইতেই মুখে মুখে এই খবর রটিয়া বাড়ির চারিদিকে ভীড় জমিয়া গেল— তাহা দেখিয়া ছাতের উপরে সেই পাহারাদার ব্যস্তভাবে ডাক দিয়া উঠিল। আর কোথা যায়! তাহার গলার আওয়াজ পাওয়া মাত্র "কে আছিস রে, আমার মনিবকে মেরে ফেললে রে" বলিয়া নাপিত "হায় হায়" শব্দে আপনার চুল দাড়ি ছিঁড়িতে লাগিল। তাহার বিকট আর্তনাদে চারিদিকে এমন হৈ হৈ পড়িয়া গেল যে স্বয়ং কাজীসাহেব পর্যন্ত গোলমাল শুনিয়া বাড়ি ছুটিয়া আসিলেন। সকলেই বলে ব্যাপার কি? নাপিত বলিল, "আর ব্যাপার কী! ঐ লক্ষ্মীছাড়া কাজী নিশ্চয়ই আমার মনিবকে মেরে ফেলেছে।" তখন মার মার করিয়া সকলে কাজীর বাড়িতে ঢুকিল। বর বেচারা পলাইবার পথ না পাইয়া, ভয়ে ও লজ্জায় একটা সিন্দুকের মধ্যে লুকাইয়া ছিল, নাপিত সেই হাজার লোকের মাঝখানে সিন্দুকের ভিতর হইতে "এই যে আমার মনিব" বলিয়া তাহাকে টানিয়া বাহির করিল। সে বেচারা এই অপমানে লজ্জিত হইয়া যতই সেখান হইতে ছুটিয়া পলাইতে যায়, নাপিত ততই তাহার পিছন পিছন ছুটিতে থাকে আর বলে, "আরে মশাই, পালান কেন? কাজীসাহেবকে ভয় কিসের? আরে মশাই, থামুন না।" ব্যাপার দেখিয়া চারিদিকে লোকজন হাসাহাসি ঠাট্টা তামাসা করিতে লাগিল। কাজীর মেয়েকে বিবাহ করিতে গিয়া, বিবাহ ত' হইলই না, মাঝে হইতে প্রাণপণে দৌড়াইতে গিয়া, হোঁচট খাইয়া বরের একটা ঠ্যাং খোঁড়া হইয়া গেল। এখানেও তাহার দুর্দশার শেষ নয়, নাপিতটা সহরের হাটে বাজারে সর্বত্র বাহাদুরি করিয়া বলিতে লাগিল, "দেখেছ? ওকে কি রকম বাঁচিয়ে দিলাম। সেদিন আমি না থাকলে কি কাণ্ডই না হ'ত। কাজীসাহেব যে রকম খ্যাপা মেজাজের লোক, কখন কী ক'রে বসত কে জানে। যা হোক, খুব বাঁচিয়ে দিয়েছি।" যে আসে তাহার কাছেই সে এই গল্প জুড়িয়া দেয়।

ক্রমে ছোকরাটির অবস্থা এমন হইল যে, সে কাহাকেও আর মুখ দেখাইতে পারে না— যাহার সঙ্গে দেখা হয় সেই জিজ্ঞাসা করে, "ভাই, কাজীর বাড়িতে তোমার কি হয়েছিল? শুনলাম ঐ নাপিত না থাকলে তুমি নাকি ভারি বিপদে পড়তে।" শেষটায় একদিন অন্ধকার রাত্রে বেচারা বাড়িঘর ছাড়িয়া বাগদাদ সহর হইতে পলাইল, এবং যাইবার সময় প্রতিজ্ঞা করিয়া গেল, "এমন দূর দেশে পলাইব, যেখানে ঐ হতভাগা নাপিতের মুখ দেখিবার আর কোন সম্ভাবনা না থাকে।"

ব্যোমকেশের মাঞ্জা

'টোকিয়ো—কিয়োটো—নাগাসাকি—য়োকোহামা'— বোর্ডের উপর প্রকাণ্ড ম্যাপ ঝুলিয়ে হারাণচন্দ্র জাপানের প্রধান নগরগুলি দেখিয়ে যাচ্ছে। এর পরেই ব্যোমকেশের পালা, কিন্তু ব্যোমকেশের সে খেয়াল‌‌ই নেই। কাল বিকেলে ডাক্তারবাবুর ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে প্যাঁচ খেলতে গিয়ে তার দু-দুটো ঘুড়ি কাটা গিয়েছিল, সে কথাটা কিছুতেই আর ভুলতে পারছে না। তাই সে বসে বসে সুতোর জন্যে কড়া রকমের একটা মাঞ্জা তৈরির উপায় চিন্তা করছে। চীনে শিরিস লাগিয়ে, তার মধ্যে বোতলচুর আর কড়্‌‌কড়ে এমেরি পাউডার মিশিয়ে সুতোয় মাখালে পর কি রকম চমৎ‌কার মাঞ্জা হবে, সেই কথা ভাবতে ভাবতে উৎ‌সাহে তার দুই চোখ কড়িকাঠের দিকে গোল হয়ে উঠছে। মনে মনে মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ির সুতোটা সবে তাল গাছের আগা পর্যন্ত উঠে, আশ্চর্য কায়দায় ডাক্তারের ছেলের ঘুড়িটাকে কাটতে যাচ্ছে এমন সময়ে গম্ভীর গলায় ডাক পড়ল— "তারপর, ব্যোমকেশ এস দেখি।"

ঐ রকম ভীষণ উত্তেজনার মধ্যে, সুতো-মাঞ্জা, ঘুড়ির প্যাঁচ সব ফেলে আকাশের উপর থেকে ব্যোমকেশকে হঠাৎ‌ নেমে আসতে হল একেবারে চীন দেশের মধ্যিখানে। একে তো ও দেশটার সঙ্গে তার পরিচয় খুব বেশি ছিল না, তার উপর যা-ও দু-একটা চীনদেশী নাম সে জানত, ওরকম হঠাৎ‌ নেমে আসবার দরুন, সেগুলো‌‌ও তার মাথার মধ্যে কেমন বিচ্ছিরি রকম ঘণ্ট পাকিয়ে গেল। পাহাড়, নদী, দেশ, উপদেশের মধ্যে ঢুকতে না ঢুকতে বেচারা বেমালুম পথ হারিয়ে ফেলল। তার কেবল‌‌ই মনে হতে লাগল যে চীনদেশের চীনে শিরিষ, তাই দিয়ে হয় মাঞ্জা। মাস্টারমশাই দু-দুবার তাড়া দিয়ে যখন তৃতীয়বার চড়া গলায় বললেন, "চীন দেশের নদী দেখাও" তখন বেচারা একেবারেই দিশেহারা আর মরিয়া মতন হয়ে বললে- "সাংহাই।" সাংহাই বলবার আর কোনো কারণ ছিল না, বোধহয় তার সেজমামার যে স্ট্যাম্পের সংগ্রহের খাতা আছে তার মধ্যে ঐ নামটাকে সে পেয়ে থাকবে- বিপদের ধাক্কায় হঠাৎ‌ কেমন করে ঐটেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।

গোটা দুই চড়-চাপড়ের পর ব্যোমকেশবাবু তাঁর কানের উপর মাস্টারমশায়ের প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে, বিনা আপত্তিতে বেঞ্চের উপর আরোহন করলেন। কিন্তু কানদুটো জুড়োতে না জুড়োতেই মনটা তার খেই-হারানো ঘুড়ির পিছনে উধাও হয়ে, আবার সুতোর মাঞ্জা তৈরি করতে বসল। সারাটা দিন বকুনি খেয়েই তার সময় কাটল, কিন্তু এর মধ্যে কত উঁচুদরের মাঞ্জা-দেওয়া সুতো তৈরি হল আর কত যে ঘুড়ি গণ্ডায় গণ্ডায় কাটা পড়ল সে জানে কেবল ব্যোমকেশ।

বিকেলবেলায় সবাই যখন বাড়ি ফিরছে, তখন ব্যোমকেশ দেখল, ডাক্তারের ছেলেটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মস্ত একটা লাল রঙের ঘুড়ি কিনছে। দেখে ব্যোমকেশ বন্ধু পাঁচকড়িকে বলল, "দেখেছিস, পাঁচু, আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আবার ঘুড়ি কেনা হচ্ছে ! এ-সব কিন্তু নেহাত বাড়াবাড়ি। না হয় দুটো ঘুড়িই কেটেছিস বাপু, তার জন্য এত কি গিরিম্বাড়ি !" এই ব'লে সে পাঁচুর কাছে তার মাঞ্জা তৈরির মতলবটা খুলে বলল। শুনে পাঁচু গম্ভীর হয়ে বলল, "তা যদি বলিস, তুই আর মাঞ্জা তৈরি করে ওদের সঙ্গে পারবি ভেবেছিস? ওরা হল ডাক্তারের ছেলে, নানা রকম ওষুধ-মশলা জানে। এই তো সেদিন ওর দাদাকে দেখলুম, শানের উপর কি একটা আরক ঢেলে দিলে, আর ভস্‌‌ভস্‌‌ করে গ্যাঁজালের মতো তেজ বেরুতে লাগল। ওরা যদি মাঞ্জা বানায়, তা হলে কারু মাঞ্জার সাধ্যি নেই যে তার সঙ্গে পেরে ওঠে। " শুনে ব্যোমেকেশের মনটা কেমন দমে গেল। তার ধ্রুব এরকম বিশ্বাস হল যে, ডাক্তারের ছেলেটা নিশ্চয় কোনো আশ্চর্য রকম মাঞ্জার খবর জানে। তা ন‌‌ইলে ব্যোমকেশের চাইতেও চার বছরের ছোট হয়ে, সে কেমন করে তার ঘুড়ি কাটল? ব্যোমকেশ স্থির করল, যেমন করে হোক ওদের বাড়ির মাঞ্জা খানিকটা যোগার করতেই হবে। সেটা একবার আদায় করতে পারলে, তারপর সে ডাক্তারের ছেলেকে দেখে নেবে।

বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি জলখাবার সেরে নিয়ে ব্যোমকেশ দৌড়ে গেল ডাক্তারবাবুর ছেলেদের সঙ্গে আলাপ করতে। সেখানে গিয়ে দেখে কি, কোণের বারান্দায় বসে সেই ছোট্ট ছেলেটা একটা ডাক্তারি থলের মধ্যে কি যেন মশলা ঘুঁটছে। ব্যোমকেশকে দেখে সে একটা চৌকির তলায় সব লুকিয়ে ফেলে সেখান থেকে সরে পড়ল। ব্যোমকেশ মনে মনে বললে, 'বাপু হে ! এখন আর লুকিয়ে করবে কি? তোমার আসল খবর আমি পেয়েছি'— এই ব'লে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলে, কোথাও কেউ নেই। একবার সে ভাবল, কেউ আস্‌‌লে এর একটুখানি চেয়ে নেব। আবার মনে হল, কি জানি চাইলে যদি না দেয়? তারপর ভাবলে, দূর ! ভারি তো জিনিস তা আবার চাইবার দরকার কি? এই একটুকু মাঞ্জা হলেই প্রায় দুশো গজ সুতোয় শান দেওয়া হবে। এই ভেবে সে চৌকির তলা থেকে এক খাবলা মশলা তুলে নিয়েই এক দৌড়ে বাড়ি এসে হাজির।

আর কি তখন দেরি সয়? দেখতে দেখতে দক্ষিণের বারান্দা জুড়ে সুতো খাটিয়ে, মহা উৎ‌সাহে মাঞ্জা দেওয়া শুরু হল। যাই বল, মাঞ্জাটা কিন্তু ভারি অদ্ভুত- ক‌‌ই, তেমন কড়কড় করছে না তো। বোধ হয়, খুব মিহি গুড়োর তৈরি- আর কালো কাচের গুঁড়ো। দুঃখের বিষয়, বেচারার কাজটা শেষ না হতেই সন্ধ্যা হয়ে এল, আর তার বড়দা এসে বললে, "যা, যা ! আর সুতো পাকাতে হবে না, এখন পড়গে যা।"

সে রাত্তিরে ব্যোমকেশের ভালো করে ঘুম‌‌ই হল না। সে স্বপ্ন দেখল যে, ডাক্তারের ছেলেটা হিংসে করে তার চমৎ‌কার সুতোয় জল ফেলে সব নষ্ট করে দিয়েছে। সকাল হতে না হতেই ব্যোমকেশ দৌড়ে গেল তার সুতোর খবর নিতে। কিন্তু গিয়েই দেখে, কে এক বুড়ো ভদ্রলোক ঠিক বারান্দার দরজার সামনে বসে তার দাদার সঙ্গে গল্প করছেন, তামাক খাচ্ছেন। ব্যোমকেশ ভাবলে, দেখ তো কি অন্যায়! এর মধ্যে থেকে এখন সুতোটা আনি কেমন করে? যাহোক, অনেক্ষণ ইতস্তত করে সে খুব সাহসের সঙ্গে গিয়ে, চট করে তার সুতো খুলে নিয়ে আসছে— এমন সময়, হঠাৎ‌ কাশতে গিয়ে বুড়ো লোকটির কল্‌‌কে থেকে খানিকটা টিকে গেল মাটিতে পড়ে। বৃদ্ধ তখন ব্যস্ত হয়ে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে, ব্যোমকেশের সেই মাঞ্জা মাখানো কাগজটা দিয়ে টিকেটাকে তুলতে গেলেন।

সর্বনাশ ! যেমন টিকের উপর কাগজ ছোঁয়ানো, অমনি কিনা ভস্‌‌ভস্‌‌ করে কাগজ জ্বলে উঠে ভদ্রলোকের আঙুল-টাঙুল পুড়ে, বারান্দার বেড়ায় আগুন-টাগুন লেগে এক হুলুস্থুল কাণ্ড ! অনেক চেঁচামেচি ছুটোছুটি আর জল ঢালাঢালির পর যখন আগুনটা নিভে এল, আর ভদ্রলোকের আঙুলের ফোস্কায় মলম দেয়া হল, তখন তার দাদা এসে তার কান ধরে বললেন, "হতভাগা ! কি রেখেছিলি কাগজের মধ্যে বল্‌‌ তো?" ব্যোমকেশ কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললে, "কিচ্ছু তো রাখিনি, খালি সুতোর মাঞ্জা রেখেছিলাম। " দাদা তার কৈফিয়ৎ‌টাকে নিতান্ত‌‌ই আজগুবি মনে করে, "আবার এয়ার্কি হচ্ছে?" ব'লে বেশ দু-চার ঘা কষিয়ে দিলেন। বেচারা ব্যোমকেশ এই ব'লে তার মনকে খুব খানিকটা সান্ত্বনা দিল যে, আর যাই হোক, তার সুতোটুকু রক্ষা পেয়েছে। ভাগ্যিস সে সময়মতো খুলে এনেছিল, ন‌‌ইলে তার সুতো‌‌ও যেত, পরিশ্রমও নষ্ট হত।

বিকেলে সে বাড়ি এসেই চটপট ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে ছাতের উপর উঠল। মনে মনে বলল, 'ডাক্তারের পো আজ একবার আসুক না, দেখিয়ে দেব প্যাঁচ খেলাটা কাকে বলে।' এমন সময়ে পাঁচকড়ি এসে বড় বড় চোখ করে বললে, "শুনেছিস্‌‌?" ব্যোমকেশ বললে, "না- কি হয়েছে?" পাঁচু বললে, "ওদের সেই ছেলেটাকে দেখে এলুম, সে নিজে নিজে দেশলাইয়ের মশলা বানিয়েছে, আর চমৎ‌কার লাল নীল দেশলাই তৈরি করছে।" ব্যোমকেশ হঠাৎ‌ লাটাই-টাটাই রেখে, এত বড় হাঁ করে জিগ্‌‌গেস করলে, "দেশলাই কিরে ! মাঞ্জা বল?" শুনে পাঁচু বেজায় চটে গেল, "বলছি লাল নীল আলো জ্বলছে, তবু বলবে মাঞ্জা, আচ্ছা গাধা যা হোক !"

ব্যোমকেশ কোনো জবাব না দিয়ে, দেশলাইয়ের মশলা-মাখানো সুতোটার দিকে ফ্যাল্‌‌ ফ্যাল্‌‌ করে তাকিয়ে র‌‌ইল। সেই সময় ডাক্তারের বাড়ি থেকে লাল রঙের ঘুড়ি উড়ে এসে, ঠিক ব্যোমকেশের মাথার উপর ফরফর করে তাকে যেন ঠাট্টা করতে লাগল। তখন সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বলল, "আমার অসুখ করেছে। "

Thursday, July 10, 2014

গোপালের পড়া

দুপুরের খাওয়া শেষ হ‌‌ইতেই গোপাল অত্যন্ত ভালোমানুষের মতন মুখ করিয়া দু-একখানা পড়ার ব‌‌ই হাতে ল‌‌ইয়া তিনতলায় চলিল। মামা জিজ্ঞাসা করিলেন, "কিরে গোপলা, এই দুপুর রোদে কোথায় যাচ্ছিস?" গোপাল বলিল, "তিনতলায় পড়তে যাচ্ছি।"

মামা— "পড়বি তো তিনতলায় কেন? এখানে বসে পড় না।"
গোপাল— "এখানে লোকজন যাওয়া-আসা করে, ভোলা গোলমাল করে, পড়বার সুবিধা হয় না।"
মামা— "আচ্ছা, যা মন দিয়ে পড়গে।"
গোপাল চলিয়া গেল, মামাও মনে মনে একটু খুশি হ‌‌ইয়া বলিলেন, "যাক, ছেলেটার পড়াশুনোয় মন আছে।"

এমন সময় ভোলাবাবুর প্রবেশ- বয়স তিন কি চার, সকলের খুব আদুরে। সে আসিয়াই বলিল, "দাদা ক‌‌ই গেল?" মামা বলিলেন, "দাদা এখন তিনতলায় পড়াশুনা করছে, তুমি এইখানে বসে খেলা কর।"

ভোলা তৎ‌ক্ষনাৎ‌ মেঝের উপর বসিয়া প্রশ্ন আরম্ভ করিল, 'দাদা কেন পড়াশুনা করছে, পড়াশুনা করলে কি হয়? কি করে পড়াশুনা করে?' ইত্যাদি। মামার তখন কাগজ পড়িবার ইচ্ছা, তিনি প্রশ্নের চোটে অস্থির হ‌‌ইয়া শেষটায় বলিলেন, "আচ্ছা ভোলাবাবু, তুমি ভোজিয়ার সঙ্গে খেলা কর গিয়ে, বিকেলে তোমায় লজেঞ্চুস এনে দেব।" ভোলা চলিয়া গেল।

আধঘণ্টা পর ভোলাবাবুর পুনঃপ্রবেশ। সে আসিয়াই বলিল, "মামা, আমিও পড়াশুনা করব।"
মামা বলিলেন, "বেশ তো আর একটু বড় হও, তোমায় রঙচঙে সব পড়ার ব‌‌ই কিনে এনে দেব।"
ভোলা— "না সেরকম পড়াশুনা নয়, দাদা যে রকম পড়াশুনা করে সেইরকম।"
মামা— "সে আবার কি রে?"
ভোলা— "হ্যাঁ, সেই যে পাতলা-পাতলা রঙিন কাগজ থাকে আর কাঠি থাকে, আর কাগজে আঠা মাখায় আর তার মধ্যে কাঠি লাগায়, সেই রকম।"

দাদার পড়াশুনার বর্ণনা শুনিয়া মামার চক্ষু স্থির হ‌‌ইয়া গেল। তিনি আস্তে আস্তে পা টিপিয়া টিপিয়া তিনতলায় উঠিলেন, চুপি চুপি ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখিলেন, তাঁর ধনুর্ধর ভাগ্নেটি জানালার সামনে বসিয়া একমনে ঘুড়ি বানাইতেছে। ব‌‌ই দুটি ঠিক দরজার কাছে তক্তপোশের উপর পড়িয়া আছে। মামা অতি সাবধানে ব‌‌ই দুখানা দখল করিয়া নিচে নামিয়া আসিলেন।

খানিক পরে গোপালচন্দ্রের ডাক পড়িল। গোপাল আসিতেই মামা জিজ্ঞাসা করিলেন, "তোর ছুটির আর কদিন বাকি আছে?"
গোপাল বলিল, "আঠারো দিন।"
মামা— "বেশ পড়াশুনা করছিস তো? না কেবল ফাঁকি দিচ্ছিস?"
গোপাল— "না, এইতো এতক্ষণ পড়ছিলাম।"
মামা— "কি ব‌‌ই পড়ছিলি?"
গোপাল— "সংস্কৃত।"
মামা— "সংস্কৃত পড়তে বুঝি ব‌‌ই লাগে না? আর অনেকগুলো পাতলা কাগজ, আঠা আর কাঠি নিয়ে নানা রকম কারিকুরি করার দরকার হয়?"
গোপালের চক্ষু তো স্থির ! মামা বলে কি? সে একেবারে হতভম্ব হ‌‌ইয়া হাঁ করিয়া মামার দিকে তাকাইয়া রহিল। মামা বলিলেন, "ব‌‌ই কোথায়?"
গোপাল বলিল, "তিনতলায়।"

মামা ব‌‌ই বাহির করিয়া বলিলেন, "এগুলো কি?" তারপর তাহার কানে ধরিয়া ঘরের এক কোণে বসাইয়া দিলেন। গোপালের ঘুড়ি লাটাই সুতো ইত্যাদি সরঞ্জাম আঠারো দিনের জন্য মামার জিম্মায় বন্ধ রহিল।

কুকুরের মালিক

ভজহরি আর রামচরণের মধ্যে ভারি ভাব। অন্তত, দুই সপ্তাহ আগেও তাহাদের মধ্যে খুবই বন্ধুতা দেখা যাইত।

সেদিন বাঁশপুকুরের মেলায় গিয়া তাহারা দুইজন মিলিয়া একটা কুকুরছানা কিনিয়াছে। চমৎকার বিলাতি কুকুর— তার আড়াই টাকা দাম। ভজুর পাঁচসিকা আর রামার পাঁচসিকা— দুইজনের পয়সা মিলাইয়া কুকুর কেনা হইল। সুতরাং দুইজনেই কুকুরের মালিক।

কুকুরটাকে বাড়িতে আনিয়াই ভজু বলিল, "অর্ধেকটা কুকুর আমার, অর্ধেকটা তোর।" রামা বলিল, "বেশ কথা! মাথার দিকটা আমার, ল্যাজের দিকটা তোর।" ভজু একটু ভাবিয়া দেখিল, মন্দ কি! মাথার দিকটা যার সেই তো কুকুরকে খাওয়াইবে, যত হাঙ্গামা সব তার। তাছাড়া কুকুর যদি কাউকে কামড়ায়, তবে মাথার দিকের মালিকই দায়ী, ল্যাজের মালিকের কোন দোষ দেওয়া চলিবে না। সুতরাং সে বলিল, "আচ্ছা, ল্যাজের দিকটাই নিলাম।"

দুইজনে দুপুর বেলায় বসিয়া কুকুরটার পিঠে হাত বুলাইয়া তোয়াজ করিত। রামা বলিত, "দেখিস, আমার দিকে হাত বোলাসনে।" ভজু বলিত, "খবরদার, এদিকে হাত আনিসনে।" দুইজনে খুব সাবধানে নিজের নিজের ভাগ বাঁচাইয়া চলিত। যখন ভজুর দিকের পা তুলিয়া কুকুরটা রামার দিকে কান চুলকাইত, তখন ভজু খুব উৎসাহ করিয়া বলিত, "খুব দে— আচ্ছা করে খামচিয়ে দে।" আবার ভজুর দিকে মাছি বসিলে রামার দিকের মুখটা যখন সেখানে কামড়াইতে যাইত, তখন রামা আহ্লাদে আটখানা হইয়া বলিত, "দে কামড়িয়ে! একেবারে দাঁত বসিয়ে দে।"

একদিন একটা মস্ত লাল পিঁপড়ে কুকুরের পিঠে কামড়াইয়া ধরিল। কুকুরটা গা ঝাড়া দিল, পিঠে জিভ লাগাইবার চেষ্টা করিল, নানারকম অঙ্গভঙ্গী করিয়া পিঠটাকে দেখিবার চেষ্টা করিল। তারপর কিছুতেই কৃতকার্য না হইয়া কেঁউ কেঁউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। তখন দুইজনে বিষম তর্ক উঠিল, কার ভাগে কামড় পড়িয়াছে। এ বলে, "তোর দিকে পিঁপড়ে লেগেছে— তুই ফেলবি," ও বলে, "আমার বয়ে গেছে পিঁপড়ে ফেলতে— তোর দিকে কাঁদছে, সে তুই বুঝবি। সেদিন দুইজনে প্রায় কথা-বার্তা বন্ধ হইবার জোগাড়।

তারপর একদিন কুকুরের কী খেয়াল চাপিল, সে তাহার নিজের ল্যাজটা লইয়া খেলা আরম্ভ করিল। নেহাৎ 'কুকুরে' খেলা— তার না আছে অর্থ, না আছে কিছু। সে ধনুকের মত একপাশে বাঁকা হইয়া ল্যাজটার দিকে তাকাইয়া দেখে আর একটু একটু ল্যাজ নাড়ে। সেটা যে তার নিজের ল্যাজ, সে খেয়াল বোধহয় তার থাকে না— তাই হঠাৎ অতর্কিতে ল্যাজ ধরিবার জন্য সে বোঁ করিইয়া ঘুরিয়া যায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরটাও নড়িয়া যায়, কাজেই ল্যাজটা আর ধরা হয় না। ভজু আর রামা এই ব্যাপার দেখিয়া উৎসাহে চিৎকার করিতে লাগিল। রামার মহা স্ফুর্তি যে ভজুর ল্যাজকে তাড়া করা হইতেছে, আর ভজুর ভারই উৎসাহ যে তার ল্যাজ রামার মুখকে ফাঁকি দিয়া নাকাল করিতেছে।

দুইজনের চিৎকারের জন্যই হোক কী নিজের ঢ্যাঁটামির জন্যই হোক কুকুরটার জেদ চড়িয়া গেল। সমস্তদিন সে থাকিয়া থাকিয়া চর্কীবাজির মত নিজের ল্যাজকে তাড়া করিয়া ফিরিতে লাগিল। এইরকমে খামখা পাক দিতে দিতে কুকুরটা হয়রান হইয়া হাঁপাইতে লাগিল, তখন রামা ব্যস্ত হইয়া উঠিল। ভজু বলিল, "আমার দিকটাই জিতিয়াছে।"

কিন্তু কুকুরটা এমন বেহায়া, পাঁচমিনিট যাইতে না যাইতেই সে আবার ল্যাজ তাড়ান শুরু করিল। তখন রামা রাগিয়া বলিল, "এইয়ো! তোমার ল্যাজ সামলাও। দেখছ না কুকুরটা হাঁপিয়ে পড়ছে?" ভজু বলিল, "সামলাতে হয় তোমার দিক সামলাও— ল্যাজের দিকে তো আর হাঁপাচ্ছে না!" রামা ততক্ষণে রীতিমত চটিয়াছে। সে কুকুরের পিছন পিছন গিয়া ধাঁই করিয়া এক লাথি লাগাইয়া দিল। ভজু বলিল, "তবে রে! আমার দিকে লাথি মারলি কেন রে?" এই বলিয়াই সে কুকুরের মাথায় ঘাড়ে কানে চটাপট কয়েকটা চাঁটি লাগাইয়া দিল। দুই দিক হইতেই রেষারেষির চোটে কুকুরটা ছুটিয়া পালাইল। তখন দুইজনে বেশ একচোট হাতাহাতি হইয়া গেল।

পরের দিন সকালে উঠিয়াই রাআম দেখে, কুকুরটা আবার ল্যাজ তাড়া করিতেছে। তখন সে কোথা হইতে একখানা দা' আনিয়া এক কোপে ক্যাঁচ্‌ করিয়া ল্যাজের খানিকটা এমন পরিপাটি উড়াইয়া দিল যে কুকুরটার আর্তনাদে ভজু ঘুমের মধ্যে লাফ দিয়া একেবারে বাহিরে আসিয়া উপস্থিত। সে আসিয়াই দেখিল কুকুরের ল্যাজ কাটা, রামার হাতে দা'। ব্যাপারটা বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না। তখন সে রামাকে মারিতে মারিতে মাটিতে ফেলিয়া তাহার উপর কুকুর লেলাইয়া দিল। কুকুরটা ল্যাজ কাটার দরুণ রামার উপর একটুও খুশী হয় নাই— সে নিমকহারাম হইয়া 'রামার দিক' দিয়াই রামার ঠ্যাঙে কামড়াইয়া দিল।

এখন দুইজনেই চায় থানায় নালিশ করিতে। রামা বলে ল্যাজটা ভারি বেয়াড়া, বারবার মুখের সঙ্গে ঝগড়া লাগাইতে চায়— তাই সে ল্যাজ কাটিয়াছে। ল্যাজ না কাটিলে কুক্র পাগল হইয়া যাইত, না হয় সর্দিগর্মি হইয়া মরিত। মারা গেলে ত' সমস্ত কুকুরই মারা যাইত, সুতরাং ল্যাজ কাটার দরুণ গোটা কুকুরটারই উপকার হইয়াছে। মুখও বাঁচিয়াছে, ল্যাজও বাঁচিয়াছে; তাতে রামারও ভাল, ভজুরও ভাল। কিন্তু ভজুর এতবড় আস্পর্ধা যে সে রামার দিকের কুকুরকে রামার উপরে লেলাইয়া দিল। মুখের দিকে ভজুর কোন দাবিদাওয়া নাই, সে দিকটা সম্পূর্ণভাবেই রামার— সুতরাং রামার অনুমতি ছাড়া ভজু কোন্‌ সাহসে এবং কোন্‌ শাস্ত্র বা আইন মতে তাজা লইয়া পরের ধনে পোদ্দারি করিতে যায়? ইহাতে অনধিকারচর্চা চুরি তছরূপ— সব রকম নালিশ চলে।

ভজু কিন্তু বলে অন্যরকম। সে বলে রামার দিকের কুকুর রামাকে কামড়াইয়াছে, তাতে ভজুর কি দোষ? ভজু কেবল 'লে লে লে' বলিয়াছিল; তাহাতে কুকুর যদি রামাকে কামড়ায়, তবে সেটা তার শিক্ষার দোষ— রামা তাহাকে ভাল করিয়া শিক্ষা দেয় নাই কেন? তাছাড়া ভজুর ল্যাজ খেলা করিতে চায়, রামার হিংসুটে মুখটা তাহাতে আপত্তি করে কেন? ভজুর ল্যাজকে কামড়াইতে যাইবার কি অধিকার আছে? আর, রামা তার কুকুরের চোখ বাঁধিয়া কিংবা মুখোস আঁটিয়া দিলেই পারিত— সে ল্যাজ কাটিতে গেল কাহার হুকুমে? একবার নালিশটি করিলে রামচরণ "বাপ বাপ" বলিয়া ছয়টি মাস জেল খাটিয়া আসিবেন— তা নইলে ভজুর নাম ভজহরিই নয়।

এখন এ তর্কের আর মীমাংসাই হয় না। আমাদের হরিশখুড়ো বলিয়াছিলেন, "এক কাজ কর্‌, কুকুরটার নাকের ডগা থেকে ল্যাজের আগা পর্যন্ত দাঁড়ি টেনে তার ডান দিকটা তুই নে, বাঁ দিকটা ওকে দে— তা হ'লেই ঠিকমতো ভাগ হবে।" কিন্তু তাহারা ওরকম "ছিল্‌কা কুকুরের" মালিক হইতে রাজী নয়। কেউ কেউ বলিল, "তা কেন? ভাগাভাগির দরকার কি? গোটা কুকুরটাই রামার, আবার গোটা কুকুরটাই ভজুর।" কিন্তু এ কথায়ও তাহাদের খুব আপত্তি। একটা বই কুকুর নাই, তার গোটা কুকুরটাই যদি রামার হয় তবে ভজুর আবার কুকুর আসে কোথা হইতে? আর রামার গোটা কুকুরটাই যদি ভজুর হয়, তবে রামার আর থাকিল কি? কুকুর থেকে কুকুর বাদ, বাকি রইল শূন্যি!

এখন তোমরা যদি ইহার মীমাংসা করিয়া দাও।

রাগের ওষুধ

কেদারবাবু বড় বদরাগী লোক। যখন রেগে বসেন, কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না।

একদিন তিনি মুখখানা বিষণ্ণ ক'রে বসে আছেন, এমন সময় আমাদের মাস্টারবাবু এসে বললেন, 'কি হে কেদারকেষ্ট, মুখখানা হাঁড়ি কেন?"

কেদারবাবু বললেন, "আর মশাই, বলবেন না। আমার সেই রূপোবাঁধানো হুঁকোটা ভেঙে সাত টুকরো হয়ে গেল— মুখ হাঁড়ির মত হবে না তো কি বদনার মত হবে?"

মাস্টারমশাই বললেন, 'বল কি হে? এ তো কাচের বাসন নয় কি মাটির পুতুল নয়— অমনি খামখা ভেঙে গেল, এর মানে কি?'

কেদারবাবু বললেন, 'খামখা ভাঙতে যাবে কেন— কথাটা শুনুন না। হল কী,— কাল রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় নি। সকালবেলা উঠেছি, মুখ হাত ধুয়ে তামাক খেতে বসব, এমন সময় কল্‌কেটা কাত হয়ে আমার ফরাসের উপর টিকের আগুন প'ড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি যেই আগুনটা সরাতে গেছি অমনি কিনা আঙ্গুলে ছ্যাঁক্‌ করে ফোস্কা প'ড়ে গেল। আছা, আপনিই বলুন— এতে কার না রাগ হয়? আরে, আমার হুঁকো, আমার কল্‌কে, আমার আগুন, আরাম ফরাস, আবার আমার উপরেই জুলুম! তাই আমি রাগ ক'রে— বেশি কিছু নয়— ঐ মুগুরখানা দিয়ে পাঁচ দশ ঘা মারতেই কিনা হতভাগা হুঁকোটা ভেঙে খান্‌ খান্‌!'

মাস্টারমশাই বললেন, 'তা যাই বল বাপু, এ রাগ বড় চণ্ডাল— রাগের মাথায় এমন কাণ্ড ক'রে বস, রাগটা একটু কমাও।' 'কমাও তো বললেন— রাগ যে মুখের কথায় বাগ মানবে— এ রাগ আমার তেমন নয়।'

'দেখো, আমি এক উপায় বলি। শুনেছি, খুব ধীরে ধীরে এক দুই তিন ক'রে দশ গুনলে— রাগটা নাকি শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তোমার যেমন রাগ, তাতে দশ-বারোতে কূলোবে না— তুমি একেবারে একশো পর্যন্ত গুনে দেখো।'

তারপর একদিন কেদারবাবু ইস্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। তখন ছুটির সময়, ছেলেরা খেলা করছে। হঠাৎ একটা মার্বেল ছুটে এসে কেদারবাবুর পায়ের হাড়ে ঠাঁই করে লাগল। আর যায় কোথা! কেদারবাবু ছাতের সমান এক লাফ দিয়ে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছেলের দল যে যেখানে পারে একেবারে সটান চম্পট্‌। তখন কেদারবাবুর মনে হল মাস্টারবাবুর কথাটা একবার পরীক্ষা ক'রে দেখি। তিনি আরম্ভ করলেন, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-

ইস্কুলের মাঝখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে বিড়্‌বিড়্‌ করে অঙ্ক বলছে, তাই দেখে ইস্কুলের দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে কয়েকজন লোক ডেকে আনল। একজন বলল, 'কী হয়েছে মশাই?' কেদারবাবু বললেন, 'ষোল-সতেরো-আঠারো-উনিশ-কুড়ি-'

সকলে বলল, 'এ কী? লোকটা পাগল হল নাকি?— আরে, ও মশাই, বলি অমনধারা কচ্ছেন কেন?' কেদারবাবু মনে মনে ভয়ানক চটলেও— তিনি গুনেই চলেছেন, 'ত্রিশ-একত্রিশ-বত্রিশ-তেত্রিশ-' আবার খানিক বাদে আর একজন জিজ্ঞাসা করল, 'মশাই, আপনার কি অসুখ করেছে? কবরেজ মশাইকে ডাকতে হবে?' কেদারবাবু রেগে আগুন হয়ে বললেন, 'উনষাট-ষাট-একষট্টি-বাষট্টি-তেষট্টি-' দেখতে দেখতে লোকের ভিড় জমে গেল— চারিদিকে গোলমাল, হৈ চৈ। তাই শুনে মাস্টারবাবু দেখতে এলেন, ব্যাপারখানা কি! ততক্ষণে কেদারবাবুর গোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তিনি দুই চোখ লাল করে লাঠি ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, 'ছিয়ানব্বুই-সাতানব্বুই-আটানব্বুই-নিরেনব্বুই-একশো— কোন্‌ হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া মিথ্যাবাদী বলেছিল একশো গুনলে রাগ থামে?' বলেই ডাইনে বাঁয়ে দুম্‌দাম্‌ লাঠির ঘা।

লোকজন আব ছুটে পালাল। আর মাস্টারমশাই এক দৌড়ে সে যে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন, আর সারাদিন বেরোলেন না।

গুপি গাইন ও বাঘা বাইন

তোমরা গান গাইতে পার? আমি একজন লোকের কথা বলব, সে একটা গান গাইতে পারত। তার নাম ছিল গুপি কাইন, তার বাবার নাম ছিল কানু কাইন। তার একটা মুদীর দোকান ছিল। গুপি কিনা একটা গান গাইতে পারত, আর সে গ্রামের আর কেউ কিছু গাইতে পারত না, তাই তারা তাকে খাতির ক’রে বলত, গুপি ‘গাইন’।

গুপি যদিও একটা বই গান জানত না, কিন্তু সেই একটা গান সে খুব ক’রেই গাইত। সেটা না গেয়ে সে তিলেকও থাকতে পারত না, তার দম আটকে আসত। যখন সে ঘরে বসে গাইত, তখন তার বাবার দোকানের খদ্দের সব ছুটে পালাত। যখন সে মাঠে গিয়ে গান গাইত, তখন মাঠের যত গরু সব দড়ি ছিঁড়ে ভাগত। শেষে আর তার ভয়ে তার বাবার দোকানে খদ্দেরই আসে না, রাখালেরাও মাঠে গরু নিয়ে যেতে পারে না। তখন একদিন কানু কাইন তাকে এই বড় বাঁশ নিয়ে তাড়া করতে সে ছুটে মাঠে চ'লে গেল। সেখানে রাখালের দল লাঠি নিয়ে আসতে বনের ভিতর গিয়ে খুব ক’রে গলা ভাঁজতে লাগল।

গুপিদের গ্রামের কাছেই আরেকটা গ্রামে একজন লোক থাকত, তার নাম ছিল পাঁচু পাইন। পাঁচুর ছেলেটির বড্ড ঢোলক বাজাবার শখ ছিল। বাজাতে বাজাতে সে বিষম ঢুলতে থাকত, আর পা নাড়ত আর চোখ পাকাত, আর দাঁত খিঁচোত, আর ভ্রুকুটি করত। তার গ্রামের লোকেরা তা দেখে হাঁ ক’রে থাকত আর বলত, ‘আহা! আ-আ-আ!! অ-অ-অ-হ-হ- হ!!!’ শেষে যখন ‘হাঃ, হাঃ, হা-হা!’ বলে বাঘের মত খেঁকিয়ে উঠত, তখন সকলে পালাবার ফাঁক না পেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে যেত। তাই থেকে সকলে তাকে বলত ‘বাঘা বাইন।’ তার এই বাঘা নামই রটে গিয়েছিল। আসল নাম যে তার কি, তা কেউ জানত না।

বাঘা ঢোলক বাজাত আর রোজ একটা ক'রে ঢোলক ভাঙত। শেষে আর পাঁচু তার ঢোলকের পয়সা দিয়ে উঠতে পারে না! কিন্তু বাঘার বাজনা বন্ধ হবে, তাও কি হয়? গ্রামের লোকেরা পাঁচুকে বলল, ‘তুমি না পার, না হয় আমরাই সকলে চাঁদা করে ঢোলকের পয়সাটা দি। আমাদের গ্রামে এমন একটা ওস্তাদ হয়েছে, তার বাজনাটা বন্ধ হয়ে যাবে!’ শেষে ঠিক হল যে গ্রামের সকলে চাঁদা করে বাঘাকে ঢোলক কিনে দেবে, আর সেই ঢোলকটি আর তার ছাউনি খুব মজবুত হবে, যাতে বাঘার হাতেও সেটা আর সহজে না ছেঁড়ে।

সে যা ঢোলক হল! তার মুখ হল সাড়ে-তিন হাত চওড়া, আর ছাউনি মোষের চামড়ার। বাঘা সেটা পেয়ে যার পর নাই খুশি হয়ে বলল, ‘আমি দাঁড়িয়ে বাজাব।’

তখন থেকে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই ঢোলক লাঠি দিয়ে বাজায়। দেড় মাস দিনরাত বাজিয়েও বাঘা সেটাকে ছিঁড়তে পারল না। ততদিনে তার বাজনা শুনে শুনে তার বাপ মা পাগল হয়ে গেল, গ্রামের লোকের মাথা ঘুরতে লাগল। আর দিনকতক এইভাবে চললে কি হত বলা যায় না। এর মধ্যে একদিন গ্রামের সকলে মিলে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে এসে বাঘাকে বললে, ‘লক্ষ্মী, দাদা! তোমাকে দশ হাঁড়ি মিঠাই দিচ্ছি, অন্য কোথাও চলে যাও, নইলে আমরা সবাই পাগল হয়ে যাব!’

বাঘা আর কি করে? কাজেই তখন তাকে অন্য একটা গ্রামে যেতে হল। সেখানে দুদিন না থাকতে সেখানকার সকলে মিলে তাকে গ্রাম থেকে বার করে দিল। তারপর থেকে সে যেখানেই যায়, সেখান থেকেই তাকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে করল কি, সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায়, ক্ষুধার সময় তার নিজের গ্রামে গিয়ে ঢোলক বাজাতে থাকে, আর গ্রামের লোক তাড়াতাড়ি তাকে কিছু খাবার দিয়ে বিদায় করে বলে, ‘বাঁচলাম!’

তারপর এমন হল যে আর কেউ তাকে খেতে দেয় না। আর তার ঢোলকের আওয়াজ শুনলেই আশপাশের সকল গ্রামের লোক লাঠি নিয়ে আসে। তখন বেচারা ভাবল, ‘আর না! মূর্খদের কাছে থাকার চেয়ে বনে চলে যাওয়াই ভাল। না হয় বাঘে খাবে, তবু আমার বাজনা চলবে!’ এই বলে বাঘা তার ঢোলকটিকে ঘাড়ে ক’রে বনে চ’লে গেল।

এখন বাঘার বেশ মজাই হয়েছে। এখন আর কেউ তার বাজনা শুনে লাঠি নিয়ে আসে না। বাঘে খাবে দূরে থাক, সে বনে বাঘ-ভালুক কিছু নেই। আছে খালি একটা ভয়ানক জানোয়ার। বাঘা আজও তাকে দেখতে পায় নি, শুধু দূর থেকে তারি ডাক শুনে ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপে আর ভাবে, ‘বাবা গো। ওটা এলেই ত ঢোলক-সুদ্ধ আমাকে গিলে খাবে!’

সে ভয়ানক জানোয়ার কিন্তু কেউ নয়, সে গুপি গাইন। বাঘা যে হাক শুনে কাঁপে, সে গুপির গলা ভাঁজা। গুপিও বাঘার বাজনা শুনতে পায়, আর বাঘারই মত ভয়ে কাঁপে। শেষে একটু ভাবল, ‘এ বনে থাকলে কখন প্রানটা যাবে, তার চেয়ে এই বেলা এখান থেকে পালাই।’ এই ভেবে গুপি চুপিচুপি বন থেকে বেরিয়ে পড়ল। বেরিয়েই দেখে, আর-একটি লোকও এক বিশাল ঢোল মাথায় ক’রে সেই বনের ভিতর থেকে আসছে। তাকে দেখেই ভারি আশ্চর্য হয়ে গুপি জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে হে?’

বাঘা বললে, ‘আমি বাঘা বাইন; তুমি কে?’

গুপি বললে, ‘আমি গুপি গাইন; তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

বাঘা বললে, ‘যেখানে জায়গা জোটে, সেইখানেই যাচ্ছি। গ্রামের লোকগুলো গাধা, গানবাজনা বোঝে না, তাই ঢোলটি নিয়ে বনে চলে এসেছিলাম। তা ভাই, এখানে যে ভয়ঙ্কর জানোয়ারের ডাক শুনেছি, তার সামনে পড়লে আর প্রাণটি থাকবে না। তাই পালিয়ে যাচ্ছি।’

গুপি বললে, ‘তাই ত! আমিও যে একটা জানোয়ারের ডাক শুনেই পালিয়ে যাচ্ছিলাম। বলো ত, তুমি জানোয়ারটাকে কোথায় বসে ডাকতে শুনেছিলে?’

বাঘা বললে, ‘বনের পূর্বধারে, বটগাছের তলায়।’

গুপি বললে, ‘আচ্ছা, সে যে আমারই গান শুনেছ। সে কেন জানোয়ারের ডাক হবে? সেই জানোয়ারটা ডাকে বনের পশ্চিম ধারে, হরতুকীতলায় ব’সে।’

বাঘা বললে, ‘সে ত আমার ঢোলকের আওয়াজ, আমি যে ঐখানে থাকতাম।’

এতক্ষণে তারা বুঝতে পারল যে, তারা তাদের নিজেদের গান আর বাজনা শুনেই ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন যে দুজনার কি হাসি! অনেক হেসে তারপর গুপি বললে, ‘ভাই, আমি যেমন গাইন, তুমি তেমনি বাইন! আমরা দুজনে জুটলে নিশ্চয় একটা কিছু করতে পারি।’

এ কথায় বাঘারও খুবই মত হল। কাজেই তারা খানিক কথাবার্তার পর ঠিক করল যে, তারা দুজনায় মিলে রাজামশাইকে গান শোনাতে যাবে। রাজা মশাই যে তাতে খুব খুশি হবেন, তাতে ত আর ভুলই নেই। চাই কি অর্ধেক রাজ্য বা মেয়ের সঙ্গে বিয়েও দিয়ে ফেলতে পারেন।

গুপির আর বাঘার মনে এখন খুবই আনন্দ, তারা রাজাকে গান শোনাতে যাবে। দুজনে হাসতে হাসতে আর নাচতে নাচতে এক প্রকাণ্ড নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল। সেই নদী পার হয়ে রাজবাড়ি যেতে হয়।

নদীতে খেয়া আছে, কিন্তু নেয়ে পয়সা চায়। বেচারারা বন থেকে এসেছে, পয়সা কোথায় পাবে! তারা বলল ‘ভাই, আমাদের কাছে ত পয়সা-পয়সা’ নেই, আমরা না হয় তোমাদের গেয়ে বাজিয়ে শোনাব, আমাদের পার করে দাও।’ তাতে খেয়ার চড়নদারেরা খুব খুশি হয়ে নেয়েকে বলল, ‘আমরা চাঁদা ক’রে এদের পয়সা দেব, তুমি এদের তুলে নাও।’

বাঘার ঢোলটি দেখেই নেয়েরও বাজনা শুনতে ভারি সাধ হয়েছিল, কাজেই সে এক কথায় আর কোনো আপত্তি করল না। গুপিকে আর বাঘাকে তুলে নিয়ে নৌকো ছেড়ে দেওয়া হল। নৌকো-ভরা লোক, ব’সে বাজাবার জায়গা কোথায় হবে? অনেক কষ্টে সকলের মাঝখানে খানিকটা জায়গা হতে হতে নৌকোও নদীর মাঝখানে এসে পড়ল। তারপর খানিকটা একটু গুনগুনিয়ে গুপি গান ধরল, বাঘা তার ঢোলকে লাঠি লাগাল, আর অমনি নৌকোসুদ্ধ সকল লোক বিষম চমকে গিয়ে গড়াগড়ি আর জড়াজড়ি করে দিল নৌকোখানাকে উলটে।

তখন ত আর বিপদের অন্ত নেই। ভাগ্যিস বাঘার ঢোলকটি এত বড় ছিল, তাই আঁকড়ে ধরে দুজনার প্রাণরক্ষা হল। কিন্তু তাদের আর রাজবাড়ি যাওয়া ঘটল না। তারা সারাদিন সেই নদীর স্রোতে ভেসে শেষে সন্ধ্যাবেলায় এক ভীষণ বনের ভিতর গিয়ে কূলে ঠেকল। সে বনে দিনের বেলায় গেলেই ভয়ে বয়ে প্রাণ উড়ে যায়, রাত্রির ত আর কথাই নেই। তখন বাঘা বলল, ‘গুপিদা, বড়ই ত বিষম দিখছি! এখন কি করি বলত।’ গুপি বলল, ‘করব আর কি?’ আমি গাইব, তুমি বাজাবে। নিতান্তই যখন বাঘে খাবে, তখন আমাদের বিদ্যোটা তাকে না দেখিয়ে ছাড়ি কেন?

বাঘা বলল, ‘ঠিক বলেছ দাদা। মরতে হয় ত ওস্তাদলোকের মতন মরি, পাড়াগেঁয়ে ভূতের মত মরতে রাজি নই!’

এই ব’লে দুজনায় সেই ভিজা কাপড়েই প্রাণ খুলে গান বাজানা শুরু করল। বাঘার ঢোলটি সেদিন কিনা ভিজা ছিল, তাইতে তার আওয়াজটি হয়েছিল যার পর নাই গম্ভীর। আর গুপিও ভাবছিল, এই তার শেষ গান, কাজেই তার গলার আওয়াজটিও খুবই গম্ভীর হয়েছিল। সে গান যে কি জমাট হয়েছিল, সে আর কি বলব? এক ঘণ্টা দু ঘণ্টা ক’রে দুপুর রাত হয়ে গেল, তবু তাদের সে গান থামছেই না।

এমন সময় তাদের দুজনারই মনে হল, যেন চারিদিকে একটা কি কাণ্ড হচ্ছে। ঝাপসা ঝাপসা কালো কালো, এই বড় বড় কি যেন সব গাছের উপর থেকে উঁকি মারতে লেগেছে। তাদের চোখগুলো জ্বলছে যেন আগুনের ভাঁটা, দাঁতগুলো বেরুচ্ছে যেন মুলোর সার। তা দেখে তখনই আপনা হতে বাঘার বাজানা থেমে গেল, তার সঙ্গে সঙ্গে দুজনার হাত-পা গুটিয়ে, পিট বেঁকে, ঘাড় বসে, চোখ বেরিযে মুখ হাঁ করে এল। তাদের গায়ে এমনি কাঁপুনি আর দাঁতে এমনি ঠকঠকি ধ’রে গেল যে, আর তাদের ছুটে পালাবারও জো রইল না।

ভূতগুলি কিন্তু তাদের কিছু করল না। তারা তাদের গান বাজনা শুনে ভারি খুশি হয়ে এসেছে, তাদের রাজার ছেলের বিয়েতে গুপির আর বাঘার বায়না করতে। গান থামতে দেখে তারা নাকিসুরে বলল, ‘থামলি কেন বাপ? বাজা, বাজা, বাজা!’

এ কথায় গুপির আর বাঘার একটু সাহস হল। তারা ভাবল, ‘এ ত মন্দ মজা নয়, তবে একটু গেয়েই দেখি না।’ এই ব’লে যেই তারা আবার গান ধরেছে, অমনি ভূতেরা একজন দুজন ক’রে গাছ থেকে নেমে এসে তাদের ঘিরে নাচতে লাগল।

সে যে কি কাণ্ডকারখানা হয়েছিল, সে কি না দেখলে বোঝবার জো আছে! গুপি আর বাঘা তাদের জীবনে আর কখনো এমন সমজদারে দেখা পায় নি। সে রাত এমনি ভাবেই কেটে গেল ভোর হলে ত আর ভূতেদের বাইরে থাকবার জো নেই, কাজেই তার একটু আগেই তারা বলল, ‘চল্‌ বাবা মোদের গোদার বেটার বে’তে! তোদের খুশি ক’রে দিব।’

গুপি বলল, ‘আমরা যে রাজাবাড়ি যাব! ভূতেরা বলল, ‘সে যাবি এখন, আগে মোদের বাড়ি একটু গানবাজনা শুনিয়ে যা! তোদের খুশি করে দিব!’ কাজেই তখন তারা দুজনে ঢোল নিয়ে ভূতেদের বাড়ি চলল। সেখান গান-বাজনা যা হল, সে আর বলে কাজ নেই।‌ তারপর তাদের বিদায় করবার সময় ভূতেরা বলল, ‘তোরা কি চাস্‌?

গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে, আমরা যেন গেয়ে বাজিয়ে সকলকে খুশি করতে পারি।’ ভূতেরা বলল, ‘তাই হবে, তোদের গানবাজনা শুনলে আর সে গান শেষ হওয়ার আগে কেউ সেখান থেকে উঠে যেতে পারবে না। আর কি চাস্‌?

গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে আমাদের যেন খাওয়া-পরার কষ্ট না হয়।’ এ কথায় ভূতেরা তাদের একটি থলে দিয়ে বলল, ‘তোরা যখন যা খেতে বা পরতে চাস, এই থলের ভিতরে হাত দিলেই তা পাবি। আর কি চাস্‌?’

গুপি বলল, ‘আর কি চাইব, তা ত বুঝতে পারছি না!’ তখন ভূতেরা হাসতে হাসতে তাদের দুজনকে দুজোড়া জুতো এনে দিয়ে বলল, ‘এই জুতো পায়ে দিয়ে তোরা যেখানে যেতে চাইবি, অমনি সেখানে গিয়ে হাজির হবি।’

তখন ত আর কোনো ভাবনাই রইলো না। গুপি আর বাঘা ভূতদের কাছে বিদায় হয়ে সেই জুতো পায়ে দিয়েই বলল, ‘তবে আমরা এখন রাজবাড়ি যাব।’ অমনে সেই ভীষণ বন কোথায় যেন মিলিয়ে গেল গুপি আর বাঘা দেখল, তারা দুজনে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত বড় আর সুন্দর বাড়ি তারা তাদের জীবনে কখনো দেখে নি। তারা তখনই বুঝতে পারল যে, এ রাজবাড়ি।

কিন্তু এর মধ্যে ভারি একটা মুশকিল হল্‌ রাজাবাড়ির ফটকে যমদূতের মত কতকগুলো দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, তারা গুপি আর বাঘাকে সেই ঢোল নিয়ে আসতে দেখেই দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘এইয়ো! কাঁহা যাতা হ্যায়?’ গুপি থতমত খেযে বলল, ‘বাবা, আমরা রাজামশাইকে গান শোনাতে এসেছি।’ তাতে দারোয়ানগুলো আরো বিষম চটে গিয়ে লাঠি দেখিয়ে বলল, ‘ভাগো হিঁয়াসে।’ গুপিও তখন নাক সিঁটকিয়ে বলল, ‘ঈস্‌! আমরা ত রাজার কাছে যাবই।’ বলতেই অমনি সেই জুতোর গুণে, তারা তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাজামশায়ের সামনে উপস্থিত হল।

রাজবাড়ির অন্দর মহলে রাজামহাশয় ঘুমিয়ে আছেন, রানী তাঁর মাথার কাছে বসে তাঁকে হাওয়া করছেন, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই, গুপি আর বাঘা সেই সর্বনেশে ঢোল নিয়ে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হল। জুতোর এমনি গুণ, দরজা জানালা সব ব রয়েছে, তাতে তাদের একটুও আটকায় নি। কিন্তু আসবার বেলা আটকাক, আর নাই আটকাক, আসবার পরে খুবই আটকাল। রানী তাদের দেখে বিষম ভয় পেয়ে, এক চিৎকার দিয়ে তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। রাজামশাই লাফিয়ে উঠে পাগলের মত ছুটাছুটি করতে লাগলেন। রাজবাড়িময় হুলস্থুল পড়ে গেল। সিপাই সান্ত্রী সব খাঁড়া ঢাল নিয়ে ছুটে এল।

বেগতিক দেকে গুপি আর বাঘার মাথায় গোল লেগে গেল। তারা যদি তখন শুধু বলে, ‘আমরা এখান থেকে অমুক জায়গায় চলে যাব, ‘তবেই তাদের জুতোর গুণে সকল ল্যাঠা চুকে যায়্‌ কিন্তু সে কথা তাদের মনেই হল না।‌ তারা গেল ছুটে পালাতে, আর দু-পা যেতে না যেতে না যেতেই বেচারারা যে মারটা খেল! জুতো, লাঠি, চাবুক, কিল, চড়, কানমলা- কিছুই তাদের বাকি রইল না। শেষে রাজামশাই হুকুম দিলেন, ‘বেটাদের নিয়ে তিন দিন হাজতে ফেলে রাখো। তারপর বিচার করে, হয় এদের মাথা কাটব, না হয় কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।’

হায় গুপি! হায় বাঘা! বেচারারা এসেছিল রাজাকে গান শুনিয়ে কতই বকশিশ পাবে ভেবে, তার মধ্যে একি বিপদ? পেয়াদারা বেঁধে মারতে মারতে একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে ফেলে রাখল। সেখানে পড়ে বেচারারা একদিন আর গায়ের ব্যাথায় নড়তে চড়তে পারল না। তাতে তেমন দুঃখ ছিল না, কিন্তু বাঘার ঢোলটি যে গেল, সেই হল সর্বনাশের কথা! বাঘা বুক মাথা চাপড়িয়ে ভেউ ভেউ ক’রে কাঁদছে, কাঁদছে আর বলছে, ‘ও গুপিদা।-ওঃ-ওঃ-হ-হ-হ-অ-অ! আরে ও গুপিদা! মার খেলাম, প্রাণ যাবে, তাতে দুঃখ নেই কিন্তু দাদা, আমার ঢোলকটি যে গেল!’

গুপির কিন্তু ততক্ষণে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সে বাঘার গায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় কা দাদা? ঢোল গিয়েছে, জুতো আর থলে তো আছে। আমরা নিতান্ত বেকুব, তাই এতগুলো মার খেলাম।’ যা হোক, যা হবার হয়ে গিয়েছে, এখন এর ভিতর থেকে একটা মজা ক’রে নিতে হবে।’ বাঘা এ কথায় একটু শান্ত হয়ে বলল, কি মজা হবে দাদা?’ গুপি বলল, আগে ত খাবার মজাটা ক’রে নিই, তারপর অন্য মজার কথা ভেবে দেখব এখন।

এই ব’লে সেই ভূতের দেওয়া থলির ভিতরে হাত দিয়ে বলল, ‘দাও ত দেখি, এক হাঁড়ি পোলাও।’ অমনে একটা সুগন্ধ যে বেরুল! তেমন পোলাও রাজরাও সচরাচর খেতে পান না। আর সে কি বিশাল হাঁড়ি! গুপি কি সেটা থলির ভিতর তেকে তুলে আনতে পারে? যা হোক, কোনমতে সেটাকে বার ক’রে এনে তারপর থলিকে বলর, ‘ভাজা ব্যঞ্জন, চাটনি, মিঠাই, দই, রাবড়ি, শরবত। শিগগির দাও।’ দেখতে দেখতে খাবার জিনিসে আর সোনা-রূপোর বাসনে ভ’রে গেল। দুজন লোকে আর কত খাবে? সে অপূর্ব খাবার খেয়ে তাদের গায়ের ব্যথা কোথায় চলে গেল তার আর ঠিক নেই।

তখন বাঘা বলল, ‘দাদা চলো এই বেলা এখান থেকে পালাই, নইলে শেষে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে? দেখাই যাক-না, কি হয়।’ এ কথায় বাঘা খুব খুশি হল। সে বুঝতে পারল যে, গুপিদা একটা-কিছু মজা করবে।

দুদিন চ’লে গেল, আর একদিন পরেই রাজা তাদের বিচার করবেন। বিচারের দিন রাত থাকতে উঠে গুপি থলের ভিতর হাত দিয়ে বলল, ‘আমাদের দুজনের রাজপোশাক চাই।’ বলতেই তার ভিতর থেকে এমন সুন্দর পোশাক বেরুল যে, তেমন পোশাক কেউ তয়েরই করতে পারে না। সেই পোশাক তারা দুজনে পরে তাদের পুরনো কাপড় আর বাসন কখানি পুঁটলি বেঁধে নিয়ে জুতো পায় দিযে তার বলল, ‘এখন আমরা মাঠে হাওয়া খেতে যাব।’ অমনি দেখে, রাজবাড়ির বাইরের প্রকাণ্ড মাঠে চ’লে এসেছে। সে মাঠের এক জায়গায় তাদের পুঁটুলিটি লুকিয়ে রেখে, তারা বেড়াতে এরে রাজবাড়ির সামনে উপস্থিত হল।

দূর থেকে তাদের আসতে দেখেই রাজার লোক ছুটে গিয়ে তাঁকে খবর দিয়েছিল যে, ‘মহারাজ, দুজন রাজা আসছেন।’ রাজাও তা শুনে তাঁর ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাঘা আর গুপি আসতেই তিনি তাদের যার পর নাই আদর দেখিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন। চমৎকার একটি ঘরে তাদের বাসা দেওয়া হল। কত চাকর, বামুন, পেয়াদা, পাইক তাদের সেবাতে লেগে গেল, তার অন্ত নেই।

তারপর গুপি আর বাঘা হাত-পা ধুয়ে জলযোগ করে একটু ঠাণ্ডা হলেই রাজামশাই তাদের খবর নিতে এলেন। তাদের পোশাক দেখে অবধিই তিনি ভেবে নিয়েছেন যে, ‘না জানি এঁরা কত বড় রাজাই হবেন।’ তারপর শেষে যখন তিনি গুপিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোন দেশের রাজা?’ তখন গুপি হাত জোড় ক’রে তাঁকে বলল, ‘মহারাজা! আমরা কি রাজা হতে পারি? আমরা আপনার চাকর!’

গুপি সত্য কথাই বলেছিল, কিন্তু রাজার তাতে বিশ্বাস হল না। তিনি ভাবলেন,‘কি ভাল মানুষ, কেমন নরম হয়ে কথা বলে। যেমন বড় রাজা, তেমনি ভদ্রলোকও দেখছি!’ তিনি তখন আর বিশেষ কিছু না বলে তাদের দুজনকে তাঁর সভায় নিয়ে এলেন। সেখানে সেদিন সে দুটো লোকের বিচার হবে-তিনদিন আগে যারা গিয়ে তাঁর শোবার ঘরে ঢুকেছিল। বিচারের সময় উপস্থিত, আসামী দুটোকে আনতে পেয়াদা গিয়েছে। কিন্তু তাদের আর কোথায় পাবে? এ তিন দিন তাদের ঘরে তালা বন্ধ ছিল, সেই তালা খুলে দেখা হল, সেখানে কেই নেই, খালি ঘর প’ড়ে আছে।

তখন ত ভারি একটা ছুটোছুটি হাঁকাহাঁকি পড়ে গেল। দারোগামশাই বিষম ক্ষেপে গিয়ে পেয়াদা গুলোকে বকতে লাগলেন। পেয়াদারা তাহ জোড় করে বলল, ‘হুজুর! আমাদের কোনো কসুর নেই। আমরা তালা দিয়ে রেখেছিলা, তার উপর আবার আগাগোড়া দরজার সামনে দাড়িয়েছিলা,। ও দুটো ত মানুষ ছিল না, ও দুটো ছিল ভুত; নইলে এর ভিতর থেকে কি ক'রে পালাল?’

এ কথায় সকলেরই বিশ্বাস হল। রাজামশাইও প্রথমে দারোগার উপর রেগে তাকে কেটেই ফেলতে গিয়েছিলেন, শেষে ঐ কথা শুনে বললেন, ‘ঠিক, ও দুটো নিশ্চয় ভূত। আমার ঘরও ত বন্ধ ছিল, তার ভিতর এত বড় ঢোল নিয়ে কি করে ঢুকেছিল?’

তা শুনে সকলেই বলল, ‘হাঁ হাঁ, ঠিক ঠিক, ও দুটো ভূত!’ বলতে বলতেই তাদের শরীর শিউরে উঠল, গা বেয়ে ঘাম পড়তে লাগল। তখন তারা বাঘার সেই ঢোলকটির কথা মনে করে বলল, ‘মহারাজ! ভূতের ঢোল বড় সর্বনেশে জিনিস! ওটাকে কখনো আপনার ঘরে রাখবেন না। ওটাকে এখুনি পুড়িয়ে ফেলুন।’

রাজামশাইও বললেন, ‘বাপ্‌ রে! ভূতের ঢোল ঘরে রাখব? এক্ষুনি ওটাকে এনে পোড়াও! যেই এ কথা বলা, অমনি বাঘা দুহাতে চোখ ঢেকে ‘হাউ- হাউ-হাউ-হাউ-হাউ’ ক’রে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগল!

সেদিন বাঘাকে নিয়ে গুপির কি মুশকিলই হয়েছিল। ঢোল পোড়াবার নাম শুনেই বাঘা কাঁদতে আরম্ভ করেছে, ঢোল এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলে না-জানি সে কি করবে। তখন, সেটা যে তারই ঢোল, সে কথা কি আর বাঘা সামলে রাখতে পারবে? সর্বনাশ! এখন বুঝি ধরা প’ড়ে প্রাণটাই হারাতে হয়।

গুপির বড়ই ইচ্ছা হচ্ছিল যে বাঘাকে নিয়ে ছুটে পালায়। কিন্তু তার ত আর জো নেই। সভায় বসবার সময় যে সেই জুতোগুলো পা থেকে খুলে রাখা হয়েছে।

এদিকে কিন্তু বাঘার কাণ্ড দেখে সভাময় এক বিষম হুলুস্থুল প’ড়ে গেছে। সবাই ভাবছে, বাঘার নিশ্চয় একটা ভারি অসুখ হয়েছে, আর সে বাঁচবে না। রাজবাড়ির বদ্যিঠাকুর এসে বাগার নাড়ী দেখে যার পর নাই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। বাঘাকে খুব ক’রে জোলাপের ওষুধ খাইয়ে তার পেটে বেলেস্তারা লাগিয়ে দেওয়া হল। তারপর বদ্যিঠাকুর বললেন, ‘এতে যদি বেদনা না সারে, তবে পিঠে আর-একটা, তাতেও না সারলে দুপাশে আর দুটো বেলেস্তারা লাগাতে হবে।’

এ কথা শুনেই বাঘার কান্না তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। তখন সকলে বালল যে, বদ্যিঠাকুর কি চমৎকার ওষুধই দিয়েছেন, দিতে বেদনা সেরে গেছে।

যা হোক, বাঘা যখন দেখল যে তার কান্নাতে ঢোল পোড়াবার কথাটা চাপা প’ড়ে গেছে, তখন সেই বেলেস্তারার বেদনার ভিতরেই তার মনটা কতক ঠাণ্ডা হল। রাজামশাই তখন তাকে খুব যত্নের সহিত তার ঘরে শুইয়ে রেখে এলেন। গুপি তার কাছে ব’সে তার বেলেনস্তারায় হাওয়া করতে লাগল।

তারপর সকলে ঘর থেকে চলে গেলে গুপি বাঘাকে বলল, ‘ছি ভাই, যেখানে-সেখানে কি এমন করে কাঁদতে আছে। দেখ দেখি, এখন কি মুশকিলটা হল।’ বাগা বলল, ‘আমি যদি না কাঁদতুম, তা হলে ত এতক্ষণে আমার ঢোলকটি পুড়িয়ে শেষ করে দিত। এখন না হয় একটু জ্বলুনি সইতে হচ্ছে, কিন্তু আমার ঢোলকটা ত বেঁচে গেছে!’

বাঘা আর গুপি এমনি কথাবার্তা বলছে। এদিকে রাজামশাই সভায় ফিরে এলে দারোগামশাই তাঁর কানে কানে বললেন, ‘মহারাজ, একটা কথা আছে, অনুমতি হয় ত বলি।’ ‘রাজা বললেন, ‘কি কথা?’ দারোগা বললেন, ‘মহারাজ, ঐ যে লোকটা গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল, সে আর তার সঙ্গের ঐ লোকটা সেই দুই ভূত। আমি চিনতে পেরেছি।’ রাজা বললেন, ‘তাই ত হে, আমারও একটু যেন সেইরকম ঠেকছিল। তা হলে ত বড় মুশকিল দেখছি। বলো ত এখন কি করা যায়?’

তখন এ কথা নিয়ে সভার ভারি একটা কানাকানি শুরু হল। কেউ বলল, ‘রোজা ডাকো, ও দুটোকে তাড়িয়ে দিক।’ আর-একজন বলল, ‘রোজা গদি তাড়াতে না পারে, তখন ত সে দুটো কে পুড়িয়ে মারুন না।’

এ কথাটা সকলেরই খুব পছন্দ হল, কিন্তু এর মধ্যে একটু মুশকিল এই দেখা গেল যে, ভূতদের পোড়াতে গেলে রাজবাড়িতেও তখন আগুন ধরে গেদে পারে। শেষে অনেক যুক্তির পর এই স্থির হল যে, একটা বাগানবাড়িতে তাদের বাসা দেওয়া হবে। বাগানবাড়ি পুড়ে গেলেও বিশেষ ক্ষতি হবে না। রাজামশাই বললেন, ‘সেই ঢোলকটাকেও তা হলে সেই বাগানবাড়িতে নিয়ে রাখা যাক। বাগানবাড়ি পোড়াবার সময় একসঙ্গে সকল আপদ চুকে যাবে।’

বাগানবাড়ি যাবার কথা শুনে গুপি আর বাঘা খুব খুশি হল। তারা ত জানে না যে এর ভিতর কি ভয়ানক ফন্দি রয়েছে। তারা খালি ভাবল যে বেশ আরামে নিরিবিলি থাকা যাবে, সংগীত চর্চার সুবিধা হতে পারে। জায়গাটি খুবই নিরিবিলি আর সুন্দর। বাড়িটি কাঠের, কিন্তু, দেখতে চমৎকার। সেখানে গিয়ে দেখতে দেখতে বাঘা ভাল হয়ে গেল। তখন গুপি তাকে বলল, ‘ভাই, আর এখানে থেকে কাজ কি? চলো আমরা এখান থেকে চ’লে যাই।’ বাঘা বলল, ‘দাদা, এমন সুন্দর জায়গায় ত আর থাকতে পাব না, দুদিন এখানে রইলামই বা। আহা, আমার ঢোলকটি যদি থাকত!’

সেদিন বাঘা বাড়ির এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, গুপি বাগানের এক জায়গায় ব’সে গুনগুন করছে, এমন সময় হঠাৎ বাঘা ভয়ানক চেঁচামেচি ক’রে উঠল। তার সকল কথা বোঝা গেল না, খালি ‘ও গুপিদা। ও গুপিদা!’ হাকটা খুবই শোনা যেতে লাগল। গুপি তখন ছুটে এসে দেখল যে, বাঘা তার সেই ঢোলকটা মাথায় ক’রে পাগলের মত নাচছে, আর যা-তা আবোল-তাবোল বলতে বলতে ‘গুপিদা গুপিদা চেঁচাচ্ছে! ঢোলক পেয়ে তার এত আনন্দ হয়েছে যে, সে আর কিছুতেই স্থির হতে পারছে না, গুছিয়ে কথাও বলতে পারছে না। এমনি ক’রে প্রায় আধঘণ্টা চলে গেলে পর বাঘা একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘গুপিদা, দেখছ কি, এই ঘরে আমার ঢোলকটি-আর কি মজা-হাঃ-হাঃ’ বলে আবার সে মিনিট দশেক খুব নেচে নিল। তারপর সে বলল, ‘দাদা, এত দুঃখের পর ঢোলকটি পেয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর রাত্রে বারান্দায় ব’সে দুজনায় খুব ক’রে গানবাজনা করা যাবে।’

রাজামশাই কিন্তু ঠিক করেছেন, সেই রাত্রেই তাদের পুড়িয়ে মারবেন। দারোগার উপর হুকুম হয়েছে যে, সেদিন সন্ধ্যার সময় সেই বাগানবাড়িতে মস্ত ভোজের আয়োজন করতে হবে।‌ দারোগামশায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক নিয়ে সেই ভোজে উপস্থিত থাকবেন। খাওয়াদাওয়ার পর গুপি আর বাঘা ঘুমিয়ে পড়লে, তাঁরা সকলে মিলে একসঙ্গে সেই কাঠের বাড়ির চারদিকে আগুন দিয়ে তাদের পালাবার পথ বন্ধ করবেন।

সেদিনকার খাওয়া বেশ ভালমতই হল। গুপি আর বাঘা ভাবল যে, লোকজন চ’লে গেলেই তারা গান বাজনা আরম্ভ করবে। দারোগামশাই ভাবলেন যে গুপি আর বাঘা ঘুমোলেই ঘরে আগুন দেবেন। তিনি তাদের ঘুম পড়াবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর ভাব দেখে যখন স্পষ্টই বোঝা গেল যে, তারা না ঘুমোলে তিনি সেখান থেকে যাবেন না, তখন গুপি বাঘাকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় প’ড়ে নাক ডাকাতে লাগল।

একটু পরেই গুপি আর বাঘা দেখল যে লোকজন সব চ’লে গেছে, আর কারু সাড়াশব্দ নেই। তারপর আর একটু দেখে যখন মনে হল যে, বাগান একেবারে খালি হয়ে গেছে, তখন তারা দুজনে বারান্দায় এসে ঢোল বাজিয়ে গান জুড়ে দিল।

এদিকে দারোগামশাই তাঁর লোকদের বলে দিয়েছেন, ‘তোরা প্রত্যেক দরজায় বেশ ভাল ক’রে আগুন ধরাবি। খবরদার, আগুন ভাল ক’রে ধরলে চ’লে যাস নি যেন!’ তিনি নিজে গিয়েছেন সিঁড়িতে আগুন ধরাতে। আগুন বেশ ভাল মতই ধরেছে, দারোগামশাই ভাবছেন, ‘এই বেলা ছুটে পালাই’। এমন সময় বাঘার ঢোল বেজে উঠল, গুপিও গান ধ’রে দিল। তখন আর দারোগামশাই বা তাঁর লোকদের কারু সেখান থেকে গড়বার জো রইল না, সকলেই পুড়ে মরতে হল। ততক্ষণে গুপি আর বাঘাও আগন দেখতে পেয়ে তাদের জুতোর জোরে, তাদের ঢোল আর থলেটি নিয়ে সেখান থেকে চম্পট দিল।

সেদিনকার আগুনে দারোগামশাই ত পুড়ে মারা গিয়েছিলেন, তাঁর দলের অতি অল্প লোকই বেঁচেছিল। সেই লোকগুলো গিয়ে রাজামশাইকে এই ঘটনার খবর দিতে তাঁর মনে বড়ই ভয় হল। পরদিন আর দু-চার জন লোক রাজসভায় এস বলল যে, তারা সেই আগুনের তামাশা দেখতে সেখানে গিয়েছিল। তারা তখন ভারি আশ্চর্যরকমের গান-বাজনা শুনেছে, আর ভূত দুটোকে শূন্যে উড়ে পালাতে স্বচক্ষে দেখেছে। তখন যা রাজামশায়ের কাঁপুনি! সেদিন তাঁর সভা করা হল না।‌ তুনি তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতরে এসে ভূতের ভয়ে দরজা এঁটে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন, এক মাসের ভিতরে আর বাইরে এলেন না।

এদিকে গুপি আর বাঘা সেই আগনের ভিতর থেকে পালিয়ে একেবারে তাদের বাড়ীর কাছের সেই বনে এসে উপস্থিত হয়েছে, যেখানে প্রথমে তাদের দেখা হয়েছিল। তাদের বড় ইচ্ছা যে এত ঘটনার পর একবার তাদের মা-বাপকে দেখে যায়। বনে এসেই বাঘা বলল, ‘গুপিদা, এইখানে না তোমার আমায় দেখা হয়েছিল? গুপি বলল, ‘হ্যাঁ!’ বাঘা বলল, ‘গুপিদা, ‘তবে এমন জায়গায় এসে কি একটু গান-বাজনা না ক' রে চলে যেতে আছে?’ গুপ বলল, ‘ঠিক বলেছ ভাই, তবে আর দেরি কেন? এই বেলা আরম্ভ ক’রে দাও।’ এই বলে তারা প্রাণ খুলে গান-বাজনা করতে লাগল।

এর মধ্যে এক আশ্চর্য ঘটনা হয়েছে। এক দল ডাকাত হাল্লার রাজার ভাণ্ডার লুটে, তার ছোট ছেলে দুটিকে সুদ্ধ চুরি করে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। রাজা অনেক সৈন্য নিয়ে তাদের পিছু পিছু প্রাণপণে ছুটেও ধরতে পারছিলেন না। গুপি আর বাঘা যখন গান ধরেছে, ঠিক সেই সময়ে সেই ডাকাতগুলো সেই বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে গান একবার শুনলে ত আর তার শেষ অবধি না শনে চ’লে যাবার জো নেই। কাজেই ডাকাতদের তখনি সেখানে দাঁড়াতে হল। সারা রাত্রের ভিতরে আর সে গান-বাজনাও থামল না, ডাকাতদেরও সেখান থেকে যাওয়া ঘটল না। সকালে হাল্লার রাজা এসে অতি সহজেই তাদের ধ’রে ফেললেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, গুপি আর বাঘার গানের গুণেই তিনি ডাকাত ধরতে পেরেছেন, তখন আর তাদের আদর দেখে কে? রাজকুমারেরাও বললেন, ‘বাবা, এমন আশ্চর্য গান আর কখখনো শোন নি। এদের সঙ্গে নিয়ে চলো!’ কাজই রাজা গুপি আর বাঘাকে বললেন, ‘তোমারা আমার সঙ্গে চলো! তেমাদের পাঁচশো টাকা ক’রে মাইনে হল।’

এ কথায় গুপি জোড়হতে রাজমশাইকে নমস্কার ক’রে বলল, ‘মহারাজ, দয়া ক’রে দুদিনের ছুটি দিতে আজ্ঞা হোক। আমরা আমাদের পিতা- মাতাকে দেখে তাঁদের অনুমতি নিয়ে আপনার রাজধানীতে গিয়ে উপস্থিত হব।’ রাজা বললেন, ‘আচ্ছা, এ দুদিন আমরা এই বনেই বিশ্রাম করছি। তোমারা তোমাদের মা-বাপকে দেখে দু’দিন পরে এসে এই খানেই আমাদের পাবে।’

গুপিকে তাড়িয়ে অবধি তার বাবা তার জন্য বড়ই দুঃখিত ছিল, কাজেই তাকে ফিরে আসতে দেখে তার বড় আনন্দ হল। কিন্তু বাঘা বেচারার ভাগ্যে সে সুখ মেলে নি। তার মা-বাপ এর বললে, ‘ঐ রে! সেই বাঘা বেটা আবার আমাদের হাড় জ্বালিয়ে মারবে। মার বেটাকে!’ বাঘা বিনয় ক’রে বলল, ‘আমি কালি আমার মা-বাবাকে দেখতে এসেছি, দুদিন থেকেই চ’লে যাব, রাজাব-টাজাব না।’ সে কথা কি তারা শোনে? তারা দাঁত খিচিয়ে তার মা-বাপের মৃত্যুর কথা বলে এই বড় লাঠি নিয়ে তাকে মারতে এল। সে প্রাণপণে ছুটে পালাতে পালাতে ইঁট মেরে তার পা ভেঙ্গে মাথা ফাটিয়ে রক্তরক্তি ক’রে দিল।

গুপি তাদের ঘরির দাওয়ায় ব’সে তার বাপের সঙ্গে কথা বলছিল। এমন সময় সে দেখন যে, বাঘা পাগলের মত হয়ে খোঁড়াতে ছুটে আসছে। তার কাপড় ছিঁড়ে ফালি ফালি আর রক্তে লাল হয়ে গেছে। অমনি সে তাড়াতাড়ি বাঘার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে? তোমার এ দশা কেন?’ গুপিকে দেখেই বাঘা একগাল হেসে ফেলেছে। তারপর সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘দাদা, বড্ড বেঁচে এসেছি! মূর্খগুলো আর একটু হলেই আমার ঢোলটি ভেঙে দিয়েছিল! গুপিদের বাড়ি এসে গুপির যত্নে আর তার মা-বাপের আদরে বাঘার দুদিন যতটা সম্ভব সুখেই কাটল। দুদিন পর গুপি তার মা-বাপের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় ব’লে গেল, ‘তোমরা তয়ের হয়ে থাকবে। আমি আবার ছুটি পেলেই এসে তোমাদের নিয়ে নিয়ে যাব।’

তারপর কয়েক মাস চ’লে গিয়েছে। গুপি আর বাঘা এখন হাল্লার রাজার বাড়িতে পরম সুখে বাস করে। দেশ বিদেশে তাদের নাম রটে গিয়েছে- ‘এমন ওস্তাদ আর কখনো হয় নি, হবেও না।’ রাজামশাই তাদের ভারি ভালোবাসেন; তাদের গান না শুনে একদিনও থাকতে পারেন না।‌ নিজের দুঃখ সুখের কথা সব গুপির কাছে বলেন। একদিন গুপি দেখল, রাজামশায়ের মুখখানি বড়ই মলিন। তিনি ক্রমাগতই যেন কি ভাবছেন, যেনতাঁর কোনো বিপদ হয়েছে।শেষে একবার তিনি গুপিকে বললেন, ‘গুপি, মুশকিলে পড়েছি, কি হবে জানি না। শুণ্ডীর রাজা আমার রাজ্য কেড়ে নিতে আসছে।’

শুণ্ডীর রাজা হচ্ছেন সেই তিনি, যিনি গুপি আর বাঘাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন্‌ তাঁর নাম শুনেই গুপির মনে একটা চমৎকার মতলব এল। সে তখন রাজামশাইকে বলল, ‘মহারাজ! এর জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আপনার এই চাকরকে হুকুম দিন, আমি এ থেকে হাসির কাণ্ড ক’রে দেব। রাজা হেসে বললেন, ‘গুপি, তুমি গাইয়ে বাজিয়ে মানুষ, যুদ্ধের ধারও ধার না, তার কিছু বোঝও না। শুণ্ডীর রাজার বড় ভারি ফৌজ, আমি কি তার কিছু করতে পারি?’ গুপি বলল, ‘মহারাজ, হুকুম পেলে একবার চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি। ক্ষতি ত কিছু হবে না।’ রাজা বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা তাই তুমি করতে পার।’ এ খথায় গুপি যার পর নাই খুশি হয়ে বাঘাকে ডেকে পরামর্শ করতে লাগল।

গুপি আর বাঘা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করেছিল্‌ বাঘার তখন কতই উৎসাহ! সে বলল, ‘দাদা, এবারে আমরা দুজনে মিলে একটা কিছু করবই করব। আমার শুধু এক কথায় একটু ভয় হচ্ছে। হঠাৎ যদি প্রাণ নিয়ে পালাবার দরকার হয়, তবে হয়ত আমি জুতোর কথা ভুলে গিয়ে সাধারণ লোকের মত কষে ছুট দিতে যাব, আর মার খেয়ে সারা হব। এমনি করে দেখ-না সেবারে আমাদের গাঁয়ে মূর্খগুলোর হাতে আমার কি দশা হ’ল!’

যা হোক, গুপি কথায় বাঘার সে ভয় কেটে গেল, আর পরদিন থেকেই তারা কাজে লাগল। দিনকতক ধরে রোজ রাত্রে তারা শুন্ডী চলে যায়, আর রাজবাড়ির আশেপাশে ঘুরে সেখানকার খবর নেয়। যুদ্ধের আয়োজন যা দেখতে পেল, সে বড়ই ভয়ঙ্কর। এ আয়োজন নিয়ে এরা হাল্লায় গিয়ে উপস্থিত হলে আর রক্ষা নেই। রাজার ঠাকরবাড়িতে রোজ মহাধুমধামে পুজো হচ্ছে। দশ দিন এমনিতর পুজো দিয়ে, ঠাকরকে খুশি ক’রে তারা হল্লায় রওনা হবে।

গুপি আর বাঘা এর সবই দেখল, তারপর একদিন তাদের ঘরে ব’সে,দরজা এঁটে,সেই ভুতের দেওয়া থলিটিকে বলল, ‘নতুন ধরনের মিঠাই চাই, খুব সরেস।’ সে কথায় থলির ভিতর থেকে মিঠাই যা বেরুল, সে আর বলবার নয়। তেমনি মিঠাই কেউ কায় নি, চোখেও দেখে নি। সেই মিঠাই নিয়ে বাঘা আর গুপি শুন্ডীর রাজার ঠাকুরবাড়ীর বিশাল মন্দিরের চূড়োয় গিয়ে বসল নীচে খুব পুজোর ধুম-ধূপধুনো শঙ্খঘন্টা কোলাহলের সীমা নেই, আঙিনায় লোকে লোকারণ্য। সেই সব লোকের মাথার উপরে ঝড়াৎ ক'রে মিঠাইগুলো ঢেলে দিয়ে বাঘা আর গুপি মন্দিরের ভিতর দিয়ে চুড়ো আঁকড়ে ধরে তামাশা দেখতে লাগল। অন্ধকারের মধ্যে সেই ধূপধূনা আর আলোর ধোঁয়ায় কেউ তাদের দেখতে পেল না।

মিঠাইগুলো আঙিনায় পড়তেই অমনি কোলাহল থেমে গেল। অনেকেই লাফিয়ে উঠল,কেউ কেই চেঁচিয়ে ছুটও দিল। তারপর দু-চার জন সাহসী লোক কয়েকটা মিঠাই তুলে, আলোর কাছে নিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল। শেষে তাদের একজন চোখ বুজে তার একটু মুখে পুরে দিল।

দিয়েই আর কথাবার্তা নেই-সে দুহাতে আঙিনা থেকে মিঠাই তুলে খালি মুখে দিচ্ছে আর নাচছে আর আহাদে চেঁচাচ্ছে। তখন সেই আঙিনা-সুদ্ধ লোক মিঠাই খাবার জন্য পাগলের মত কাড়াকাড়ি আর কিচিরমিচির করতে লাগল।

এদিকে কয়েকজন ছুটে গিয়ে রাজামশাইকে বলছে, ‘মহারাজ! ঠাকুর আজ পুজোয় তুষ্ট হয়ে স্বর্গ থেকে প্রসাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে যে কি অপূর্ব প্রসাদ, সে কথা আমরা বলতেই পারছি না।’ সে কথা শুনবামাত্রই রাজামশাই প্রাণপণে কাছা গুঁজতে গুঁজতে ঊর্ধ্বশ্বাসে এস ঠাকুরবাড়িতে উপস্থিত হলেন।

কিন্তু হায়! ততক্ষণে সব প্রসাদ শেষ হযে গিয়েছিল্‌ সমস্ত উঠোন ঝাঁট দিয়েও রাজামশাইয়ের জন্য একটু প্রসাদের গুঁড়ো পাওয়া গেল না। তখনি তিনি ভারি চটে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কি অন্যায়। পুজো করি আমি,আর প্রসাদ খেয়ে শেষ কর তোমরা! আমার জন্যে একটু গুঁড়োও রাখ না! তোমাদের সকলকে ধ’রে শুলে চড়াব।’ এ কথায় সকলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জোড়াহাতে বলল, ‘দোহাই মাহরাজ! আপনার প্রসাদ কি আমরা খেয়ে শেষ করতে পারি? বাপ্‌ রে! আমরা খেতে না খেতেই ঝাঁ করে কোনখান দিয়ে ফুরিয়ে গেল।! আজ আমাদের প্রসাদগুলো আপনি মাপ করুন; কালতকের যত প্রসাদ, সব মহারাজ একাই খাবেন।’ রাজা তাতে বললেন, ‘আচ্ছা তাই হবে। খবরদার ! মনে তাকে যেন।’

পরদিন রাজামশাই প্রসাদ খাবেন, তাই একপ্রহর বেলা থাকতেই তিনি ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় এসে আকাশের পানে তাকিয়ে বসে আছেন। আর সকলে ভযে ভয়ে একটু দূরে বসে তাঁকে ঘিরে তামাশা দেখছে। আজ পুজোর ঘটা অন্যদিনের চেয়ে শতগুণ্‌ সবাই ভাবছে, দেবতা তাতে খুশি হয়ে রাজামশাইকে আরো ভাল প্রসাদ দেবেন।

রাত-দুপুরের সময় গুপি আর বাঘা আরো আশ্চর্যরকমের মিঠাই নিয়ে এসে মন্দিরের চুড়োয় বসল। আজ তাদের পরনে খুব জমকালো পোশাক, মাথায় মুকুট, গলায় হার, হাতে বালা, কানে কুণ্ডল। তারা দেবতা সেজে এসেছে। ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তবু রাজামশাই আকাশের পানে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় গুপি আর বাঘা হাসতে হাসতে তাঁর উপরে সেই মিঠাইগুলো ফেলে দিল। তাতে রাজামশাই প্রথমে একটা চিৎকার দিয়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন, তারপর তাড়াতাড়ি সামলিয়ে নিয়ে,হাতে মিঠাই তুলে মুখে দিতে লাগলেন, আর ধেই ধেই ক'রে নাচনটা যে নাচলেন!

এমন সময় গুপি আর বাঘা হঠাৎ মন্দিরের চুড়ো থেকে নেমে এসে রাজার সামনে দাঁড়াল। তাদের দেখে সকলে ‘ঠাকুর এসেছেন’ বলে কে আগে গড় করবে ভেবে ঠিক পায় না। রাজামশাই ত লম্বা হয়ে মাটিতে পড়েই রয়েছেন, আর খালি মাথা ঠুকছেন। গুপি তাঁকে বলল, ‘মহারাজ! তোমার নাচ দেখে আমরা বড়ই তুষ্ট হয়েছি। এসো তোমার সঙ্গে কোলাকুলি করি।’ রাজা তা শুনে যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। দেবতার সঙ্গে কোলাকুলি, সে কি কম সৌভাগ্যের কথা?

কোলাকুলি আরম্ভ হল। সকলে ‘জয় জয়’ বলে চেঁচাতে লাগল। সেই অবসরে গুপি আর বাঘা রাজামশাইকে খুব ক’রে জড়িয়ে বলল, ‘এখন তবে আমাদের ঘরে যাব!’ বলতে বলতেই তারা তাঁকে সুদ্ধ একেবারে এসে তাদের নিজের ঘরে উপস্থিত। ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় সেই লোকগুলো অনেকক্ষন ধরে হাঁ করে আকাশের পানে চেয়ে রইল। তারপর তখন রাজামশাই আর ফিরলেন না, তখন তারা যে যার ঘরে এসে বলল, ‘কি আশ্চর্যই দেখলাম! রাজামশাই সশরীরে স্বর্গে গেলেন! দেবতারা নিজে তাঁকে নিতে এসেছিলেন!’

এদিকে রাজামশাই গুপি আর বাঘার কোলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের ঘরে এসেও অনেকক্ষণ তাঁর জ্ঞান হয় নি। ভোরের বেলায় তিনি চোখ মেলে দেখলেন যে, সেই দুটো ভূত তাঁর মাথার কাছে ব’সে আছে। অমনি তিনি তাদের পায়ে প’ড়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘দোহাই বাবা! আমাকে খেয়ো না! আমি দুশো মোষ মেরে তোমাদের পুজো করব।’

গুপি বলল, ‘মহারাজ, আপনার কোনো ভয় নেই। আমরা ভূতও নই, আপনাকে খেতেও যাচ্ছি না।’ রাজামশাইয়ের কিন্তু তাতে একটুও ভরসা হল না। তিনি আর কোনো কথা না ব’লে মাথা গুঁজে বসে কাঁপতে লাগলেন।

এদিকে বাঘা এসে হাল্লার রাজাকে বলল, ‘কার রাত্রে আমরা শুণ্ডীর রাজাকে ধ’রে এনেছে। একন কি আজ্ঞা হয়?’ হাল্লার রাজা বললেন, ‘তাঁকে নিয়ে এসো!’

দুই রাজার যখন দেখ হল, তখন শুণ্ডীর রাজা বুঝতে পারলেন যে তাঁকে ধ’রে এনেছে । হাল্লা জয় করা ত তাঁর ভাগ্যে ঘটলই না, এখন প্রাণটিও যাবে। কিন্তু হাল্লার রাজা তাঁকে প্রাণে না মেরে শুধু তাঁর রাজ্যই কেড়ে নিলেন। তারপর তিনি গুপি আর বাঘাকে বললেন, ‘তোমরাই আমাকে বাঁচিয়েছ, নইলে হয়ত আমার রাজ্যও যেত, প্রাণও যেত। শুন্ডীরাজ্যের অর্ধেক আর আমার দুটি কন্যা তোমাদের দুজনকে দান করলাম’। তখন খুবই একটা ধুমধাম হল। গুপি আর বাঘা হাল্লার জামাই হয়ে আর শুণ্ডীর অর্ধেক রাজ্য পেয়ে পরম আনন্দে সঙ্গীতের চর্চা করতে লাগল। গুপির মা- বাপের মান্য আর সুখ তখন দেখে কে?



এক যে ছিল রাজা (বাহ। এইভাবেই গাও, চেঁচাইয়ো না)
এক যে ছিল রাজা
তার ভারি দুখ, ভারি দুখ (রাজার বড় দুঃখ রে, আমরা বুঝেছি)
দেখ রাজা
কাঁদে রাজা
আহা রাজা
বেচারা রাজার ভারি দুখ (আহ বড় ভালো... বেঁধেছ তো গানখানা)

দুঃখ কিসে হয় 
দুঃখ কিসে হয় (কিসে হয় বলো তো?)
অভাগার অভাবে জেনো শুধু নয়
যার ভাণ্ডারে রাশি রাশি... সোনা দানা ঠাসা ঠাসি
যার ভাণ্ডারে রাশি রাশি... সোনা দানা ঠাসা ঠাসি
তারও হয় (তারই বেশি হয়)
জেনো সেও সুখী নয়
সুখী নয় (ডাকাইতের ভয় তো, রাতে ঘুম নাই)

দুঃখ যাবে কি
দুঃখ যাবে কি
বিরস বদনে রাজা ভাবে কি
বলি যারে তারে দিয়ে শাস্তি
রাজা কখনও সোয়াস্তি পাবে কি
দুঃখ যাবে কি (এই গান শুনলে পরে রাজা আমাদের ছেড়ে দিত রেহ)

দুঃখ কিসে যায়
দুঃখ কিসে যায়
প্রাসাদেতে বন্দি রওয়া বড় দায়
একবার ত্যাগিয়ে সোনারও গদি
রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায়
তবে রাজা শান্তি পায়।

Saturday, July 5, 2014

দাশুর কীর্তি

নবীনচাঁদ ইস্কুলে এসেই বলল, কাল তাকে ডাকাতে ধরেছিল। শুনে স্কুল সুদ্ধ সবাই হাঁ হাঁ করে ছুটে এল। 'ডাকাতে ধরেছিল ? বলিস কিরে!' ডাকাত না তো কি? বিকাল বেলায় সে জ্যোতিলালের বাড়িতে পড়তে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফিরবার সময় ডাকাতরা তাকে ধরে তার মাথায় চাঁটি মেরে, তার নতুন কেনা শখের পিরানটিতে কাদাজলের পিচ্‌কিরি দিয়ে গেল। আর যাবার সময় ব'লে গেল, "চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক- নইলে দড়াম্‌ করে তোর মাথা উড়িয়ে দেব।" তাই সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রাস্তার ধারে প্রায় বিশ মিনিট দাঁড়িয়েছিল, এমন সময় তার বড়মামা এসে তার কান ধরে বাড়িতে নিয়ে বললেন, "রাস্তায় সঙ্‌ সেজে ইয়ার্কি করা হচ্ছিল ?" নবীনচাঁদ কাঁদ-কাঁদ গলায় ব'লে উঠল, "আমি কি করব ? আমায় ডাকাতে ধরেছিল-" শুনে তার মামা প্রকাণ্ড এক চড় তুলে বললেন, "ফের জ্যাঠামি !" নবীনচাঁদ দেখল মামার সাথে তর্ক করা বৃথা- কারণ, সত্যি সত্যি তাকে ডাকাতে ধরেছিল, একথা তার বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করানো শক্ত ! সুতরাং তার মনের দুঃখ এতক্ষণ মনের মধ্যেই চাপা ছিল ।

যাহোক ইস্কুলে এসে তার দুঃখ অনেকটা বোধ হয় দূর করতে পেরেছিল, কারণ স্কুলে অন্তত অর্ধেক ছেলে তার কথা শুনবার জন্য একেবারে ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়েছিল, এবং তার প্রত্যেকটি ঘামাচি, ফুস্‌কুড়ি আর চুলকানির দাগটি পর্যন্ত তারা আগ্রহ করে ডাকাতির সুস্পষ্ট প্রমাণ ব'লে স্বীকার করেছিল। দু একজন যারা তার কনুয়ের আঁচড়টাকে পুরনো ব'লে সন্দেহ করেছিল, তারাও বলল যে হাঁটুর কাছে যে ছড়ে গেছে, সেটা একেবারে টাটকা নতুন। কিন্তু তার পায়ের গোড়ালিতে যে ঘায়ের মতো ছিল সেটাকে দেখে কেষ্টা যখন বললে, "ওটা তো জুতোর ফোস্কা", তখন নবীনচাঁদ ভয়ানক চটে বললে, "যাও, তোমাদের কাছে আর কিছুই বলব না।" কেষ্টাটার জন্য আমাদের আর কিছু শোনাই হল না।

ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে, ঢং ঢং করে ইস্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেল। সবাই যে যার ক্লাশে চলে গেলাম, এমন সময় দেখি পাগলা দাশু একগাল হাসি নিয়ে ক্লাশে ঢুকছে। আমরা বললাম, "শুনেছিস? কাল নবুকে ডাকাতে ধরেছিল।" যেমন বলা অমনি দাশরথি হঠাৎ হাত পা ছুঁড়ে বই-টই ফেলে, খ্যাঃ-খ্যাঃ-খ্যাঃ-খ্যাঃ করে হাসতে হাসতে একেবারে মেঝের উপর বসে পড়ল। পেটে হাত দিয়ে গড়াগড়ি করে, একবার চিৎ হয়ে, একবার উপুড় হয়ে, তার হাসি আর কিছুতেই থামে না।

দেখে আমরা তো অবাক! পণ্ডিত মশাই ক্লাশে এসেছেন, তখনও পুরোদমে তার হাসি চলছে। সবাই ভাবলে, 'ছোঁড়াটা ক্ষেপে গেল না কি?' যাহোক, খুব খানিকটা হুটোপাটির পর সে ঠাণ্ডা হয়ে, বই-টই গুটিয়ে বেঞ্চের উপর উঠে বসল। পণ্ডিত মশাই বললেন, "ওরকম হাসছিলে কেন?" দাশু নবীনকে দেখিয়ে বললে, "ঐ ওকে দেখে।" পণ্ডিত মশাই খুব কড়া ধমক লাগিয়ে তাকে ক্লাশের কোনায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। কিন্তু পাগলার তাতেও লজ্জা নেই, সে সারাটি ঘণ্টা থেকে থেকে বই দিয়ে মুখ আড়াল করে ফিক্‌ফিক্‌ করে হাসতে লাগল।

টিফিনের ছুটির সময় নবু দাশুকে চেপে ধরল, "কিরে দেশো! বড় যে হাসতে শিখেছিস!" দাশু বললে, "হাসব না? তুমি কাল ধুনচি মাথায় দিয়ে কি রকম নাচটা নেচেছিলে, সে তো আর তুমি নিজে দেখো নি? দেখলে বুঝতে কেমন মজা!" আমরা সবাই বললাম, "সে কি রকম ? ধুনচি মাথায় নাচছিল মানে ?" দাশু বললে, "তাও জানো না? ঐ কেষ্টা আর জগাই- ঐ যা! বলতে না বারণ করেছিল !" আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, "কি বলছিস ভালো করেই বল্‌ না ।" দাশু বললে, "কালকে শেঠেদের বাগানের পিছন দিয়ে নবু একলা একলা বাড়ি যাচ্ছিল, এমন সময় দুটো ছেলে— তাদের নাম বলা বারণ— তারা দৌড়ে এসে নবুর মাথায় ধুনচির মত কি একটা চাপিয়ে, তার গায়ের উপর আচ্ছা করে পিচ্‌কিরি দিয়ে পালিয়ে গেল ।" নবু ভয়ানক রেগে বলল, "তুই তখন কি করছিলি ?" দাশু বললে, "তুমি তখন মাথার থলি খুলবার জন্য ব্যাঙের মত হাত পা ছুঁড়ে লাফাচ্ছিলে দেখে আমি বললাম— ফের নড়বি তো দড়াম করে মাথা উড়িয়ে দেব। শুনে তুমি রাস্তার মধ্যে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে, তাই আমি তোমার বড়মামাকে ডেকে আনলাম ।" নবীনচাঁদ যেমন বাবুয়ানা, তেমনি তার দেমাক- সেইজন্য কেউ তাকে পছন্দ করত না, তার লাঞ্ছনার বর্ণনা শুনে সবাই বেশ খুশি হলাম । ব্রজলাল ছেলেমানুষ, সে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বললে, "তবে যে নবীনদা বলছিল, তাকে ডাকাতে ধরেছে ?" দাশু বললে, "দূর বোকা ! কেষ্টা কি ডাকাত ?" বালতে না বলতেই কেষ্টা সেখানে হাজির । কেষ্টা আমাদের উপরের ক্লাশে পড়ে, তার গায়েও বেশ জোর আছে । নবীনচাঁদ তাকে দেখামাত্র শিকারী বেড়ালের মত ফুলে উঠল । কিন্তু মারামারি করতে সাহস পেল না, খানিকক্ষণ কট্‌মট্‌ করে তাকিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল। আমরা ভাবলাম গোলমাল মিটে গেল।

কিন্তু তার পরদিন ছুটির সময় দেখি, নবীন তার দাদা মোহনচাঁদকে নিয়ে হন্‌হন্‌ করে আমাদের দিকে আসছে । মোহনচাঁদ ম্যাট্রিক ক্লাশে পড়ে, সে আমাদের চাইতে অনেক বড়, তাকে ওরকম ভাবে আসতে দেখেই আমরা বুঝলাম, এবার একটা কাণ্ড হবে । মোহন এসেই বলল, "কেষ্টা কই ?" কেষ্টা দূর থেকে তাকে দেখেই কোথায় সরে পড়েছে, তাই তাকে আর পাওয়া গেল না। তখন নবীনচাঁদ বললে, "ওই দাশুটা সব জানে, ওকে জিজ্ঞাসা কর।" মোহন বললে, "কি হে ছোকরা, তুমি সব জানো নাকি?" দাশু বললে, "না, সব আর জানব কোত্থেকে- এইতো সবে ফোর্থ ক্লাশে পড়ি, একটু ইংরিজি জানি, ভূগোল বাংলা জিওমেট্রি—" মোহনচাঁদ ধমক দিয়ে বললে, "সেদিন নবুকে যে কারা সব ঠেঙিয়েছিল, তুমি তার কিছু জানো কিনা?" দাশু বললে, "ঠাঙায়নি তো- মেরেছিল, খুব অল্প মেরেছিল ।" মোহন একটুখানি ভেংচিয়ে বললে, "খুব অল্প মেরেছে, না ? তবু কতখানি শুনি ?" দাশু বললে, "সে কিছুই না— ওরকম মারলে একটুও লাগে না ।" মোহন আবার ব্যাঙ্গ করে বললে, "তাই নাকি? কি রকম মারলে পরে লাগে?" দাশু খানিকটা মাথা চুলকিয়ে তারপর বললে, "ঐ সেবার হেডমাস্টার মশাই তোমায় যেমন বেত মেরেছিলেন সেই রকম!" এ কথায় মোহন ভয়ানক চটে দাশুর কান ম'লে চিৎকার করে বলল, "দেখ্‌ বেয়াদপ ! ফের জ্যাঠামি করবি তো চাব্‌‌কিয়ে লাল করে দেব। কাল তুই সেখানে ছিলি কিনা, আর কি কি দেখছিলি খুলে বলবি কিনা?"

জানোই তো দাশুর মেজাজ কেমন পাগলাটে গোছের, সে একটুখানি কানে হাত বুলিয়ে তারপর হঠাৎ মোহনচাঁদকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে বসল । কিল, ঘুষি, চড়, আঁচড়, কামড় সে এমনি চটপট চালিয়ে গেল যে আমরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম । মোহন বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি যে, ফোর্থ ক্লাশের একটা রোগা ছেলে তাকে অমন ভাবে তেড়ে আসতে সাহস পাবে- তাই সে একেবারে থতমত খেয়ে কেমন যেন লড়তেই পারল না । দাশু তাকে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে মাটিতে চিৎ করে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "এর চাইতেও ঢের আস্তে মেরেছিল ।" ম্যাট্রিক ক্লাশের কয়েকটি ছেলে সেখানে দাড়িয়েছিল, তারা যদি মোহনকে সামলে না ফেলত, তাহলে সেদিন তার হাত থেকে দাশুকে বাঁচানোই মুশকিল হত ।

পরে একদিন কেষ্টাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, "হ্যাঁরে, নবুকে সেদিন তোরা অমন করলি কেন ?" কেষ্টা বললে, "ঐ দাশুটাই তো শিখিয়েছিল ওরকম করতে । আর বলছিল, তা হলে একসের জিলিপি পাবি । আমরা বললাম, "কৈ আমাদের তো ভাগ দিলিনে?" কেষ্টা বলল, "সে কথা আর বলিস কেন? জিলিপি চাইতে গেলুম, হতভাগা বলে কিনা আমার কাছে কেন ? ময়রার দোকানে যা, পয়সা ফেলে দে, যত চাস জিলিপি পাবি ।

আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না কেবল মিচ্‌‌কেমি করে ?

ওয়াসিলিসা

ওয়াসিলিসা এক সওদাগরের মেয়ে। তার মা ছিল না, কেউ ছিল না— ছিল খালি এক দুষ্টু সৎমা আর ছিল সে সৎমার দুটো ডাইনীর মত মেয়ে।

ওয়াসিলিসার মা যখন মারা যান, তখন তিনি তাকে একটা কাঠের পুতুল দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, "একে কখন ছেড়ো না, সর্বদা কাছে কাছে রেখো, আর যখন তোমার বিপদ-আপদ ঘটবে, একে চারটি কিছু খেতে দিও। তবেই দেখবে, এ মানুষের মত তোমার সঙ্গে কথা বলবে; তখন এর পরামর্শমতো চ'লো।" তারপরে এতদিনে ওয়াসিলিসা বড় হয়ে উঠেছে।

সৎমা তার মেয়েদের সঙ্গে মিলে কেবল ওয়াসিলিসার অনিষ্ট চেষ্টা করত। ওয়াসিলিসা দেখতে যেমন সুন্দর, তার কথাবার্তা তেমনি মিষ্টি। গ্রামের যত লোক সবাই তাকে ভালবাসে। আর সেই সৎমার যে দুটো মেয়ে— তাদের দাঁত যেমন উঁচু, চোখ তেমনি টেরা, নাক তার চেয়েও বাঁকা,— আর তার উপরে এমনি দুষ্টু আর হিংসুকে আর ঝগড়াটে, তাদের কে ভালবাসবে? তাই তারা হিংসায় ওয়াসিলিসাকে ধরে মারত। গ্রামের এক কিনারায় ওয়াসিলিসাদের বাড়ি আর বাড়ির পাশেই প্রকাণ্ড বন। সে বনের মধ্যে সবুজ মাঠের উপরে ডাইনীবুড়ি বাবায়াগার বাড়ি। সে বুড়ি মানুষ খায়,— সুন্দর মেয়েদের ধরতে পেলে ত খুব উৎসাহ করেই খায়।

একদিন রাত্রে দুষ্টু সৎমা তার মেয়েদের বলল, "এক কাজ কর্‌। ঘরের আগুনটা নিবিয়ে দে ত। তা হলেই ওয়াসিলিসাকে আবার আগুন আনবার জন্য সেই সবুজ মাঠে বাবায়াগার বাড়িতে পাঠানো যাবে; আর বাবায়াগা তাকে ধরে গিলে ফেলবে। কেমন মজা!" যেই এ কথা বলা, অমনি বড় মেয়েটা উঠে ইচ্ছে করে ছাইমাটি চাপা দিয়ে আগুন নিবিয়ে দিল। আর সকলে চেঁচাতে লাগল, "ঐ যা! আগুন তো নিবে গেল! ওয়াসিলিসা, ওয়াসিলিসা, শিগ্‌গির ওঠ। বনের মধ্যে সবুজ মাঠ আছে, তার মধ্যে বাবায়াগার বাড়ি, তার বাড়ির আগুন নাকি কখনও নিবে যায় না। শিগ্‌গির যাও, দৌড়ে যাও, সেই আগুন খানিকটা নিয়ে এস।"

এই না ব'লে তারা ওয়াসিলিসার চুল ধরে হিড়্‌হিড়্‌ ক'রে টেনে তাকে বাড়ির বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে, ঘরের খিল এঁটে দিল। ওয়াসিলিসা বাইরে বসে কাঁদছে, এমন সময় তার সেই ছোট কাঠের পুতুলের কথা মনে হল। তখন সে তাড়াতাড়ি তার কাপড়ের মধ্যে থেকে পুতুলটাকে বের করে তার মুখে একটু খাবার দিয়ে বলতে লাগল, "কাঠের পুতুল, খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।" অমনি কাঠের পুতুলের চোখদুটো জ্বলে উঠল, ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল— তারপর সে বলতে লাগল—

"কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়, ওয়াসিলিসার কিসের ভয়? তুমি ভয় পেও না, বাবায়াগার বাড়ি সোজা চলে যাও।"

ওয়াসিলিসা চলতে লাগল। রাত গেল, সকাল গেল, দুপুর গেল, তখন দেখা গেল সবুজ মাঠ, তার ঠিক মধ্যখানে ভাঙ্গাচোরা সাদা বাড়ি, তার গায়ে সারি সারি মড়ার খুলি, তার দরজা জানালা ফটক কবাট আস্ত আস্ত হাড়ের তৈরী। হুড়্‌কো কব্‌জা কাঁটা পেরেক কোথাও কিছু নেই— কিছু দিয়ে বাঁধা নেই, জোড়া নেই, অথচ বাড়িখানা চারটে পাখির ঠাঙের উপর ঠিক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওয়াসিলিসা অবাক হয়ে দেখছে, এমন সময় হঠাৎ একটা সাদা লোক ঝক্‌ঝকে সাদা পোশাক পরে, সাদা ঘোড়ায় চড়ে সাঁই সাঁই করে কোথা থেকে ছুটে এল। এসেই, সোজা বাড়ির ফটকের উপরে ছুটে পড়ল আর ধাঁ করে বাড়ির সঙ্গে মিশে গেল। ওয়াসিলিসা চেয়ে দেখল, তখন বিকেল হয়ে এসেছে, রোদ পড়ে আসছে।

তারপর একজন লোক এল, রাঙা সূর্যের মত লাল তার রং— তার পোশাক, তার ঘোড়া, সবই লাল। সেও তেমনি ছুটে গিয়ে বাড়ির মধ্যে মিশে গেল। ওয়াসিলিসা দেখল, সন্ধ্যে হয়েছে, চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।

তারপর একজন এল অন্ধকারের মতো কালো-কালো পোশাক, কালো ঘোড়া। সে যেই বাড়ির মধ্যে মিশে গেল আর চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেবল সেই বাড়ির গায়ে মড়ার খুলিগুলো আপনা থেকে ঝক্‌ঝক্‌ করে জ্বলে উঠল— আর দাঁত বের করে চারদিকে আলো ছড়াতে লাগল।

তারপরে একটা প্রকাণ্ড হামানদিস্তা হাঁকিয়ে বাবায়াগা নিজে এসে হাজির। সে এসেই ত' ওয়াসিলিসার গন্ধ পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে গেল। ওয়াসিলিসা আগুন নিতে এসেছে শুনেই সে বলল, "বটে! আগুনের বুঝি দাম লাগে না? তিন দিন আমার বাড়িতে কাজ কর— যদি ভাল কাজ করতে পারিস আগুন পাবি; আর, তা যদি না পারিস তোকে আমি ঝোল রেঁধে খাব। আচ্ছা, এখন আমার খাবারগুলো উনুন থেকে নামিয়ে আমায় দে ত'।"

ওয়াসিলিসা খাবার এনে দিল। বুড়ি চেটেপুটে খেয়ে বলল, "কাল সকালে আমি বেরিয়ে যাব। সন্ধ্যার সময় এসে যেন দেখতে পাই— আমার ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়েছে, আমার রান্না ঠিকমত করা হয়েছে, আর ঐ কোণে এক ঝুড়ি সোনার ধান দেখবি তার মধ্যে অনেক কাঁকর, অনেক খুদ, আর তার চাইতেও বেশি কালো ধান মেশানো আছে— সমস্ত ঝেড়ে বেছে রাখিস। খবরদার, কিছু ভুল হয় না যেন।"

ওয়াসিলিসা বসে বসে কাঁদতে লাগল। তখন তার কাঠের পুতুলের কথা মনে হ'ল। সে পুতুলের মুখে একটু খাবার দিয়ে বলতে লাগল, "কাঠের পুতুল! খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।" কাঠের পুতুলের চোখ দুটো জ্বলে উঠল, ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল, সে বলতে লাগল,—"কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়, ওয়াসিলিসার কিসের ভয়! তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও গিয়ে।"

ওয়াসিলিসা ঘুমাতে গেল। সকালবেলায় বাবায়াগা তার হামানদিস্তায় চড়ে বেরিয়ে গেল। আর কি আশ্চর্য! ঘরদোর সব আপনা থেকে ঝাঁট হয়ে গেল। খাবারগুলো উনুনে চড়ে আপনা থেকে সিদ্ধ হতে লাগল। ওয়াসিলিসা অবাক হয়ে সেই ধানগুলো দেখতে গিয়ে দেখে তার কাঠের পুতুল সমস্ত ধান বেছে সোনার ধান, কালো ধান, কাঁকর আর খুদ সব আলগা করে ফেলেছে!

বিকেলবেলা সাদা লোকটা ফিরে এল, সন্ধ্যার সময় লাল লোকটা ফিরে এল আর ঘুট্‌ঘুটে অন্ধকার রাত্রে কালো লোকটা ফিরে এল, —তারপর ঝম্‌ঝম্‌ খট্‌খটাং করে হামানদিস্তা হাঁকিয়ে বাবায়াগা ঘরে এল। এসেই সে হামানদিস্তার বাঁটটা দিয়ে ঘরের সব জায়গায় ধাঁই ধাঁই ক'রে মেরে দেখতে লাগল, কোনখান থেকে ধুলো পড়ে কিনা! তারপর যখন সে দেখল ঝাঁট দেওয়াও ঠিক হয়েছে, খাবারও রান্না হয়েছে, ধানও বাছা হয়েছে, তখন সে রেগে চিৎকার করে বলতে লাগল, হতভাগী মেয়ে, কে তোকে বাঁচিয়েছে— শিগ্‌গির আমায় বল্‌।" ওয়াসিলিসা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, "আমার মা মারা যাবার সময় আমায় আশীর্বাদ করেছিলেন, তাতেই আমি বেঁচেছি।" এই না শুনে ডাইনী বুড়ি ভয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, "ওরে বাবারে! কার আশীর্বাদ নিয়ে আমার এসেছ রে! আমার সর্বনাশ করবে যে! এই নে তোর আগুন নে— আমার বাড়ি থেকে শিগ্‌গির বেরো।" এই ব'লে সে ওয়াসিলিসাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল, আর একটি মড়ার খুলি তাকে ছুঁড়ে দিল।

ওয়াসিলিসা একটা লাঠির আগায় খুলিটাকে চড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গেল। কিন্তু বাড়িতে নিলে কি হবে? তার যে সেই সৎমা আর তার দুটো দুষ্টু মেয়ে, তাদের ত' কেউ কোনদিন আশীর্বাদ করেনি— তারা মহা খুশী হয়ে যেই আগুনটা নিতে গিয়েছে অমনি তাদের গায়ে আগুন ধরে গিয়ে তারা ত' মরলই, বাড়িঘর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

ওয়াসিলিসা আবার বসে কাঁদতে লাগল। তখন কাঠের পুতুলের কথা মনে হল। পুতুলের মুখে খাবার দিয়ে বলল, "কাঠের পুতুল, খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।" কাঠের পুতুল জেগে উঠে বলল— "কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়— ওয়াসিলিসার কিসের ভয়! তুমি রাজার কাছে যাও তিনি তোমায় সুখী করবেন।"

রাজা এমন চমৎকার মেয়ে কখনো কোথাও দেখেননি— তিনি তার কথা শুনবেন কি— তাড়াতাড়ি সিংহাসন থেকে উঠে পড়লেন, বললেন, "আহা কি সুন্দর মেয়েটি গো! তুমি কার মেয়ে? কি তোমার দুঃখ? তুমি আমায় বিয়ে কর— আমার রাজ্যের রানী হয়ে থাক— আমি তোমার সব দুঃখ দূর করব।"

এমনি করে ওয়াসিলিসা রানী হলেন— আর সেই কাঠের পুতুল সোনার খাটে মখমলের গদিতে, রেশমের চাদরের উপর ঝক্‌ঝকে পোশাক পরে শুয়ে থাকত।

পাগলা দাশু

আমাদের স্কুলের যত ছাত্র তাহাদের মধ্যে এমন কেহই ছিল না, যে পাগলা দাশুকে না চিনে। যে লোক আর কাহাকেও জানে না, সেও সকলের আগে দাশুকে চিনিয়া ফেলে। সেবার এক নতুন দারোয়ান আসিল, একেবারে আন্‌‌কোরা পাড়াগেঁয়ে লোক, কিন্তু প্রথম যখন সে পাগলা দাশুর নাম শুনিল, তখনই আন্দাজে ঠিক করিয়া লইল যে, এই ব্যক্তিই পাগলা দাশু। কারণ মুখের চেহারায়, কথাবার্তায়, চাল-চলনে বোঝা যাইত যে তাহার মাথায় একটু 'ছিট' আছে। তাহার চোখ দুটি গোল গোল, কান দুটি অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় একবস্তা ঝাঁকড়া চুল। চেহারাটা দেখিলেই মনে হয়—

ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ডু তাহে ভারি
যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারি।
সে যখন তাড়াতাড়ি চলে অথবা ব্যস্ত হইয়া কথা বলে, তখন তাহার হাত পা ছোঁড়ার ভঙ্গী দেখিয়া হঠাৎ কেন জানি চিংড়িমাছের কথা মনে পড়ে।

সে যে বোকা ছিল তাহা নয়। অঙ্ক কষিবার সময়, বিশেষত লম্বা লম্বা গুণ-ভাগের বেলায় তাহার আশ্চর্য মাথা খুলিত। আবার এক এক সময় সে আমাদের বোকা বানাইয়া তামাশা দেখিবার জন্য এমন সকল ফন্দি বাহির করিত যে, আমরা তাহার বুদ্ধি দেখিয়া অবাক হইয়া থাকিতাম।

'দাশু' অর্থাৎ দাশরথি, যখন প্রথম আমাদের ইস্কুলে ভরতি হয়, তখন জগবন্ধুকে আমাদের 'ক্লাশের ভালো ছেলে' বলিয়া সকলে জানিত। সে পড়াশোনায় ভালো হইলেও, তাহার মতো অমন একটি হিংসুটে ভিজেবেড়াল আমরা আর দেখি নাই। দাশু একদিন জগবন্ধুর কাছে কি একটা ইংরাজি কথার মানে জিজ্ঞাসা করিতে গিয়াছিল। জগবন্ধু তাহাকে খামখা দুকথা শুনাইয়া বলিল, "আমার বুঝি আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই ? আজ একে ইংরাজি বোঝাব, কাল ওর অঙ্ক কষে দেব, পরশু আর একজন আসবেন আর এক ফরমাইস নিয়ে— ঐ করি আর কি !" দাশু সাংঘাতিক চটিয়া বলিল, "তুমি তো ভারি ছ্যাঁচড়া ছোটলোক !" জগবন্ধু পণ্ডিত মশায়ের কাছে নালিশ করিল, "ঐ নতুন ছেলেটা আমায় গালাগালি দিচ্ছে।" পণ্ডিত মহাশয় দাশুকে এমনি ধমক দিয়া দিলেন যে বেচারা একেবারে দমিয়া গেল।

আমাদের ইংরাজি পড়াইতেন বিষ্টুবাবু। জগবন্ধু তাঁহার প্রিয় ছাত্র। পড়াইতে পড়াইতে যখনই তাঁহার বই দরকার হয়, তিনি জগবন্ধুর কাছে বই চাহিয়া লন। একদিন তিনি পড়াইবার সময় 'গ্রামার' চাহিলেন, জগবন্ধু তাড়াতাড়ি তাহার সবুজ কাপড়ের মলাট দেওয়া 'গ্রামার' খানা বাহির করিয়া দিল। মাস্টার মহাশয় বইখানি খুলিয়াই হঠাৎ গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "বইখানা কার ?" জগবন্ধু বুক ফুলাইয়া বলিল, "আমার"। মাস্টার মহাশয় বলিলেন, "হুঁ— নতুন সংস্করণ বুঝি ? বইকে-বই একেবারে বদলে গেছে।" এই বলিয়া তিনি পড়িতে লাগিলেন— 'যশোবন্ত দারোগা— লোমহর্ষক ডিটেকটিভ নাটক।' জগবন্ধু ব্যাপারখানা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মতো তাকাইয়া রহিল। মাস্টার মহাশয় বিকট রকম চোখ পাকাইয়া বলিলেন, "এই সব জ্যাঠামি বিদ্যে শিখছ বুঝি ?" জগবন্ধু আম্‌তা আম্‌তা করিয়া কি যেন বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু মাস্টার মহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, "থাক্‌ থাক্‌, আর ভালমানুষি দেখিয়ে কাজ নেই— ঢের হয়েছে।" লজ্জায় অপমানে জগবান্ধুর দুই কান লাল হইয়া উঠিল— আমরা সকলেই তাহাতে বেশ খুশি হইলাম। পরে জানা গেল যে, এটিও দাশু ভায়ার কীর্তি, সে মজা দেখিবার জন্য উপক্রমণিকার জায়গায় ঠিক ঐরূপ মলাট দেওয়া একখানা বই রাখিয়া দিয়াছিল।

দাশুকে লইয়া আমরা সর্বদাই ঠাট্টাতামাশা করিতাম এবং তাহার সামনেই তাহার বুদ্ধি ও চেহারা সম্বন্ধে অপ্রীতিকর সমালোচনা করিতাম। তাহাতে একদিনও তাহাকে বিরক্ত হইতে দেখি নাই। এক এক সময়ে সে নিজেই আমাদের মন্তব্যের উপর রঙ চড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত গল্প বলিত। একদিন সে বলিল, "ভাই, আমাদের পাড়ায় যখন কেউ আমসত্ত্ব বানায় তখনই আমার ডাক পড়ে। কেন জানিস ?" আমরা বলিলাম, "খুব আমসত্ত্ব খাস বুঝি ?" সে বলিল, "তা নয়। যখন আমতত্ত্ব শুকোতে দেয়, আমি সেইখানে ছাদের উপর বার দুয়েক চেহারাখানা দেখিয়ে আসি। তাতেই, ত্রিসীমানার যত কাক সব ত্রাহি ত্রাহি করে ছুটে পালায় কাজেই আর আমসত্ত্ব পাহারা দিতে হয় না।"

একবার সে হঠাৎ পেন্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢল্‌ঢলে পায়জামার মতো পেন্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং তাহার কাছে ভারি একটা ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, "পেন্টেলুন পরেছিস্‌ কেন ?" দাশু এক গাল হাসিয়া বলিল, "ভালো ইংরাজি শিখব ব'লে।" আর একবার সে খামখা নেড়া মাথায় এক পট্টি বাঁধিয়া ক্লাশে আরম্ভ করিল এবং আমরা সকলে তাহা লইয়া ঠাট্টা তামাশা করায় যারপরনাই খুশি হইয়া উঠিল। দাশু আদপেই গান গাহিতে পারে না, তাহার যে তালজ্ঞান বা সুরজ্ঞান একেবারে নাই, একথা সে বেশ জানে। তবু সেবার ইনস্পেক্টার সাহেব যখন ইস্কুল দেখিতে আসেন, তখন আমাদের খুশি করিবার জন্য চিৎকার করিয়া গান শুনাইয়াছিল। আমরা কেহ ওরূপ করিলে সেদিন রীতিমত শাস্তি পাইতাম, কিন্তু দাশু 'পাগলা' বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।

একবার ছুটির পরে দাশু অদ্ভুত এক বাক্স লইয়া ক্লাসে হাজির হইল। মাস্টার মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, "কি দাশু, ও বাক্সের মধ্যে কি আছে ?" দাশু বলিল, "আজ্ঞে, আমার জিনিসপত্র।" জিনিসপত্রটা কিরূপ হইতে পারে, এই লইয়া আমাদের মধ্যে বেশ একটা তর্ক হইয়া গেল। দাশুর সঙ্গে বই, খাতা, পেনসিল, ছুরি সবই তো আছে, তবে আবার জিনিসপত্র কি বাপু? দাশুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সে সোজাসুজি কোনো উত্তর না দিয়া বাক্সটিকে আঁকড়াইয়া ধরিল এবং বলিল, "খবরদার, আমার বাক্স তোমরা কেউ ঘেঁটো না।" তাহার পর চাবি দিয়া বাক্সটাকে একটুখানি ফাঁক করিয়া, সে তাহার ভিতর দিয়া কি যেন দেখিল, এবং 'ঠিক আছে' বলিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বিড় বিড় করিয়া হিসাব করিতে লাগিল। আমি একটুখানি দেখিবার জন্য উঁকি মারিতে গিয়াছিলাম— অমনি পাগলা মহা ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরাইয়া বাক্স বন্ধ করিয়া ফেলিল।

ক্রমে আমাদের মধ্যে তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইল। কেহ বলিল, "ওটা ওর টিফিনের বাক্স— ওর মধ্যে খাবার আছে।" কিন্তু একদিনও টিফিনের সময় তাহাকে বাক্স খুলিয়া কিছু খাইতে দেখিলাম না। কেহ বলিল, "ওটা বোধ হয় ওর মানি-ব্যাগ— ওর মধ্যে টাকা পয়সা আছে, তাই ও সর্বদা কাছে কাছে রাখতে চায়। আর একজন বলিল, "টাকা পয়সার জন্য অত বড় বাক্স কেন? ও কি ইস্কুলে মহাজনী কারবার খুলবে নাকি ?"

একদিন টিফিনের সময় দাশু হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া, বাক্সের চাবিটা আমার কাছে রাখিয়া গেল আর বলিল, "ওটা এখন তোমার কাছে রাখো, দেখো হারায় না যেন। আর আমার আসতে যদি একটু দেরি হয়, তবে তোমরা ক্লাশে যাবার আগে ওটা দারোয়ানের কাছে দিও।" এই বলিয়া বাক্সটি দারোয়ানের জিম্মায় রাখিয়া বাহির হইয়া গেল। তখন আমাদের উৎসাহ দেখে কে! এতদিনে সুবিধা পাওয়া গিয়াছে, এখন দারোয়ানটা একটু তফাৎ গেলেই হয়। খানিক বাদে দারোয়ান তাহার রুটি পাকাইবার লোহার উনানটি ধরাইয়া, কতকগুলি বাসনপত্র লইয়া কলতলার দিকে গেল। আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, দারোয়ান আড়াল হওয়া মাত্র, আমরা পাঁচ-সাতজনে তাহার ঘরের কাছে সেই বাক্সের উপর ঝুঁকিয়া পড়িলাম। তাহার পর আমি চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া দেখি বাক্সের মধ্যে বেশ ভারি একটা কাগজের পোঁটলা ন্যাকড়ার ফালি দিয়া খুব করিয়া জড়ানো। তাড়াতাড়ি পোঁটলার প্যাঁচ খুলিয়া দেখা গেল, তাহার মধ্যে একখানা কাগজের বাক্স— তাহার ভিতর আর একটা ছোট পোঁটলা। সেটি খুলিয়া একখানা কার্ড বাহির হইল, তাহার এক পিঠে লেখা, 'কাঁচকলা খাও' আর একটি পিঠে লেখা 'অতিরিক্ত কৌতুহল ভালো নয়।' দেখিয়া আমরা এ-উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। সকলের শেষে একজন বলিয়া উঠিল, "ছোকরা আচ্ছা যা হোক, আমাদের বেজায় ঠকিয়েছে।" আর একজন বলিল, "যেমন ভাবে বাঁধা ছিল তেমনি করে রেখে দাও, সে যেন টেরও না পায় যে আমরা খুলেছিলাম। তাহলে সে নিজেই জব্দ হবে।" আমি বলিলাম, "বেশ কথা। ও আস্‌‌লে পরে তোমরা খুব ভালোমানুষের মতো বাক্সটা দেখাতে বলো আর ওর মধ্যে কি আছে, সেটা বার বার করে জানতে চেয়ো।" তখন আমরা তাড়াতাড়ি কগজপত্রগুলি বাঁধিয়া, আগেকার মতো পোঁটলা পাকাইয়া বাক্সে ভরিয়া ফেলিলাম।

বাক্সে চাবি দিতে যাইতেছি, এমন সময় হো হো করিয়া একটা হাসির শব্দ শোনা গেল— চাহিয়া দেখি পাঁচিলের উপরে বসিয়া পাগলা দাশু হাসিয়া কুটিকুটি। হতভাগা এতক্ষণ চুপি চুপি তামাশা দেখিতেছিল। তাখন বুঝিলাম আমার কাছে চাবি দেওয়া, দারোয়ানের কাছে বাক্স রাখা, টিফিনের সময় বাহিরে যাওয়ার ভান করা এ সমস্ত তাহার শয়তানি। খামখা আমাদের আহাম্মক বানাইবার জন্যই সে মিছিমিছি এ কয়দিন ক্রমাগত একটা বাক্স বহিয়া বেড়াইতেছে।

সাধে কি বলি 'পাগলা দাশু ?'